চেতনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাসের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়। মানুষের একত্রে বসবাসের জন্য এই ব্যবস্থা খুবই জরুরি। নইলে প্রত্যেক মানুষকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করতে হয় যেটা কোনোভাবে কাম্য নয়। যৌথভাবে জীবনযাপন করলে মানুষ মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ না হলে বিপর্যয় ঘটে সমাজব্যবস্থায়। সেজন্য রাষ্ট্র আইন করে নানা নিয়মনীতি প্রচলন করে। মানুষ সেই আইন মেনে চলে। আইনের বরখেলাপ হলে শাস্তি ভোগ করতে হয়। সেজন্য সামাজিক আদর্শ মানবচেতনার বড় দিক। পরস্পরের সঙ্গে সম্প্রীতির জায়গা রক্ষা করার জন্য আইন মেনে চলতে হয়। আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষ যখন সামাজিক আদর্শ কিংবা জীবনের চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে পথ চলে, তখন সে একজন আদর্শবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়। সবাই তাকে মান্য করে। প্রয়োজনে তার কাছে গিয়ে সামাজিক সমস্যার সমাধান দিতে বলে।
উন্নত চেতনাগত দিক ছাড়া সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি হয় না। সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে বিপন্ন হয় মানুষের জীবন। কারণ যে যার ইচ্ছেমতো যেমন খুশি তেমন ভাবে জীবন কাটাতে পারে না। একজনের বিশৃঙ্খলা আর একজনকে সমস্যায় ফেলে। সেজন্য গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে সামাজিক আদর্শ রক্ষা করা সামাজিক মূল্যবোধের ন্যূনতম শর্ত।
বঙ্গবন্ধু কিশোর বয়স থেকে সামাজিক আদর্শ ও উন্নত চেতনার দিকটি নিজের মধ্যে লালন করতে শিখেছিলেন তাঁর শিক্ষক আবদুল হামিদের কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “এই সময় আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তাঁর জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন। গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হত তাঁর সঙ্গে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক। যদি কোনো মুসলমান চাউল না দিত আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম।” এভাবে তিনি সামাজিক আদর্শ ও উন্নত চেতনার জায়গা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজের জীবনে।
বঙ্গবন্ধু পরিণত বয়সে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার সময় থেকে তাঁর গণমানুষকে ‘দুঃখী মানুষ’ হিসেবে তাঁর বক্তৃতায় বিবৃতিতে উল্লেখ করতেন। তাঁদের কথা তিনি সবসময় চিন্তা করতেন। স্বাধীনতার পরে তিনি রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণ নীতি ঘোষণা উপলক্ষে তিনি বেতার-টেলিভিশনে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে উল্লেখ করেন, “আমার প্রিয় দেশবাসী, বিগত পঁচিশ বছর ধরে আপনারা ক্ষুধা, বঞ্চনা, অশিক্ষা এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী শোষকেরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটা নিকৃষ্টতম উপনিবেশে পরিণত করেছিল। দুঃসহ ও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। পিষ্ট হচ্ছিলাম শোষণের জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়ে। দারিদ্র্যের ও অনাহারের বিষবাষ্পে যখন আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তখন তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসকরা আমাদের কষ্টার্জিত তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়ে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলার কাজে মত্ত ছিল। ন্যায়বিচার দাবী করায় মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ আমাদের উপর নেমে এসেছিল। সমসাময়িককালে নিষ্ঠুরতম স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ৩০লাখমানুষ প্রাণ দিয়েছে, আর ৩ কোটি মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এসব কিছুই ঘটেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য। আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ধূসর পাণ্ডুর জমি, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের স্বাধীনতা যদি এদেরকে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুষ্টি অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তা’হলে সে স্বাধীনতা মিথ্যা, সে আত্মত্যাগ বৃথা। আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উৎসবের লগ্নে দাঁড়িয়ে, আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি, বিধ্বস্ত মুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফল ভোগ করবে। আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নততর জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ‘অনার্জিত রয়ে গেছে স্বপ্নপূরণ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর আমার আব্বা যদি ইচ্ছে করতেন ইয়াহিয়ার অধীনে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। আর আমরা পিন্ডি থেকে বিআইএ-র বিমানে এসে ঢাকায় পা দিতে পারতাম। হয়তো একদিন এই মাটির মানুষগুলোকে দেখতাম করুণার চোখে। কিন্তু আমার আব্বা কখনো যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাবার রাজনীতি করেননি, বারবার চেয়েছেন এদেশের মানুষের অধিকার।’
শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর দুঃখী মানুষদের ন্যায্য মজুরির চিন্তা করতেন। ১৯৭২ সালের ১ মে বঙ্গবন্ধু মে দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন, “আমার প্রিয় শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা, স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে এবারই সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হচ্ছে।... আপনারা অতীতে বার বার আমার ডাকে সাড়া দিয়ে নির্ভীক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমার বিশ্বাস, এবারও আপনারা আমার আহ্বানে মনে-প্রাণে এগিয়ে আসবেন। অতীতে আমরা একটি মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিগড়ে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো শ্রেণীবিশেষের ভোগ-লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্ত এই সম্পদকে অপচয় করতে দেয়া হবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। এই ব্যবস্থায় দেশের সমুদয় উৎপাদিত ও প্রাকৃতিক সম্পদ কৃষক-শ্রমিক ও সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে সুষমভাবে বন্টন করা হবে। যদিও বাধা অনেক, সমস্যার শেষ নেই, তবুও লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে।”
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ থেকে বোঝা যায় তিনি শ্রেণি বৈষম্যের অবসান চেয়েছিলেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতি শ্রমজীবী মানুষদের শোষণ করে এবং এর ফলে সামাজিক আদর্শ কিংবা মানব জীবনের উন্নত চেতনা গড়ে ওঠে না। শোষক-শোষিতেরবঞ্চনায় বৈষম্যের সমাজ তৈরি হয়। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানে চারটি মূলনীতির উল্লেখ রেখেছিলেন। সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি কাল মার্ক্সের তাত্ত্বিক মূল্যায়ন থেকে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ করেননি। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন এটি ছিল সেই মূল্যায়নের বড় দিক। সেজন্য তিনি ১ মে’র ভাষণে আরও উল্লেখ করেন, “আমার গরীব শ্রমিক ভাই ও বোনেরা, আপনারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের উপযোগী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করুন। আমাদেরকে পরিশ্রম করতে হবে, উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। দেশের সম্পদ বাড়িয়ে আমরা জীবনযাত্রার প্রকৃত মান উন্নয়ন করতে সফল হব। আজকের এই মে দিবসে আসুন আমরা এই শপথ গ্রহণ করি যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য আমরা অবিরাম সংগ্রাম করে যাব।”
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ‘বঙ্গবন্ধু : আমার রাজনীতি ও সংসদ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘সংসদে আরও একটা বিষয় প্রায়ই লক্ষ্য করতাম, পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্পিকার বিব্রত হতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হতেন না। উদার না হলে, গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন না হলে এটা ভাবাই যেত না। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্টে আতাউর রহমান খান, এমএন লারমাসহ বিরোধী দলের কয়েকজন এমপি ছিলেন। তখনো দেখেছি তারা কথা বলতে চাইলেই সুযোগ পেতেন। প্রায় সময় বঙ্গবন্ধুই স্পিকারকে বলে সে সুযোগ করে দিতেন। বিরোধী দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা একটা মনোযোগ ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শের যত অমিলই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধু কখনো বিরোধী দলের নেতাদের কটাক্ষ করে কিছু বলতেন না বরং তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল।’
বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়েছিলেন শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে। তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতির যতদিন দুনিয়ার থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর।”
পাকিস্তান আমলের শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং দুঃখী মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ও দায়িত্বের টানে তিনি সমাজতন্ত্রে আস্থা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তেমন একটি উন্নত চেতনা ও সামাজিক আদর্শ তৈরি করার সুযোগ তিনি পাননি। বিশ্বাসঘাতক কুচক্রীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে।
সামাজিক আদর্শে নারী-পুরুষের সমতার জায়গাটি তিনি মূল্যায়ন করেছেন নিজের সচেতন বোধে। নারী সমাজকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেবার লক্ষ্যে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে উল্লিখিত হয়েছে, “জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।” স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি তাঁদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। বীরাঙ্গনা অর্থ বীর নারী সে সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল সেখানে লেখা ছিল ‘বীর/ বীরাঙ্গনা সৈনিক’। সার্টিফিকেটে ছেলেদের নামের সঙ্গে ‘বীর’ রাখা হয়েছে, মেয়েদের নামের সঙ্গে ‘বীরাঙ্গনা’ রাখা হয়েছে। তবে সৈনিক শব্দটি কোনো সার্টিফিকেটে কাটা হয়নি। নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তিনি সামাজিক আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধ নারীর এই স্বীকৃতির মর্যাদা দেয়নি। নারী প্রবল অবমাননার ভেতর দিনযাপন করেছে। বঙ্গবন্ধু মেয়েদের প্রশিক্ষণের এবং চাকরির ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অনেক মেয়ের বাবা দরখাস্তে পিতা হিসেবে নিজের নাম লেখার অনুমতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, কোনো বাবা তার নাম লিখতে না দিলে বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দিও। এভাবে তিনি সামাজিক আদর্শের জায়গা সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধের অভাবের কারণে নারী মর্যাদার আসন পায়নি। নিপীড়িত-অবহেলিত জীবনযাপন করেছে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। পুরো সমাজ যদি মানুষের মর্যাদার বিষয়ে তৈরি না থাকে তবে এভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। সেজন্য সামাজিক আদর্শ গড়ে তোলা সরকার প্রধানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু সামাজিক আদর্শের দিকটি মানুষের সামনে উপস্থাপন করার পরও মানুষ অপরিশীলিত মূল্যবোধের কারণে সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। নারীর জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছিল। মানুষ স্বাধীনতার দিগন্তে নারীকে মহীয়ান করতে পারেনি। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সামাজিক আদর্শের মূল্যবোধ। মানুষ বুঝতে চায়নি যে নারী-পুরুষের সমতার জায়গা মানবজনমের ধারাবাহিকতার মূল স্রোত।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে জমি লাভের ব্যাপারে নারী-পুরুষের সমতার জায়গার কথা উল্লেখ করেন, ‘নয়াচীনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেল লাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে। যদি কোনো জমি ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে থাকে তাহলে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়। জমি যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তা পুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; স্বামী জমি যাহা পাবে, স্ত্রীও সমপরিমাণ জমি পাবে এবং দুজনকেই পরিশ্রম করতে হবে। কারণ, দুজনই জমির মালিক। স্বামী কাজ করবে আর স্ত্রী বসে খাবে এ প্রথা চীনের থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমি ট্রেন থেকে পুরুষ ও মেয়েলোক অনেককেই হাল-চাষ করতে দেখেছি।’
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্ব পালনকালে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শিক্ষিত সমাজ গঠনে তিনি সুদুরপ্রসারী লক্ষ্যমাত্রায় নিয়োজিত হন। ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ করেন। প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা যেন অবৈতনিক শিক্ষা লাভ করে এটা ছিল লক্ষ্য। দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষায় গড়ে তোলা সামাজিক আদর্শের বড় দিক। বঙ্গবন্ধু এখানে তাঁর সরকার প্রধানের দায়িত্ব অটল রেখেছিলেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সবসময় সোচ্চার ছিলেন। দুর্নীতি সামাজিক আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কারণ পরস্পরের সহযোগিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীই সমাজ। সুতরাং সামাজিক আদর্শের চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুর দার্শনিক ভাবনার বড় দিক। তিনি ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছে, ‘এক জায়গায় এক ঘটনা শুনলাম, এক সরকারি কর্মচারী ঘুষ খেয়েছিল, তাকে জনসাধারণ ধরাইয়া দেয়। ঘুষ খাওয়ার অপরাধে তার ফাঁসি হয়েছিল। সেই হতে কর্মচারীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। কেউই ঘুষ খেতে সাহস পায় না।’
পাশাপাশি দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতি প্রবল থাকলে দেশ প্রাকৃতিক কারণে দুর্দশাগ্রস্ত হয় না। মানুষ সেটা অনায়াসে কাটিয়ে উঠতে পারে। এই প্রসঙ্গে তিনি ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘চীন বহু বড় দেশ, সমস্ত দেশটায় চাষাবাদ হতে পারে। সরকার জনগণের সাহায্য নিয়ে হাজামজা নদী, খাল কাটতে শুরু করেছে। প্রত্যেক বৎসর বন্যায় লক্ষ একর জমির ফসল পূর্বে নষ্ট হয়ে যেত; আজ আর সাধারণ বর্ষায় ফসল নষ্ট হতে পারে না। একমাত্র হোয়াংহো নদীতে বন্যায় বৎসরে লক্ষ লক্ষ একর ফসল নষ্ট হতো। সরকার হোয়াংহো নদীতে বাঁধ বাঁধবে বলে জনগণকে ডাক দিলো। লক্ষ লক্ষ লোক পেটে খেয়ে সরকারকে সাহায্য করলো। হোয়াংহোকে বলা হয় চীনের দুঃখ। চীনারা আগে কোনোদিন এই বাঁধ বেঁধে রাখতে পারে নাই। কিন্তু বিপ্লবের পর দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতির দৃঢ়তায় চীনারা অসাধ্য সাধন করেছে। এখন আর হোয়াংহো নদীতে বন্যা হতে পারে না।’
নিজের রাজনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের এই মিল তিনি নিজ দর্শনে লালন করেছেন। বইজুড়ে অনেক উদ্ধৃতি আছে। যা উল্লেখ করা যায়। ৪ আগষ্ট ১৯৬৬ তারিখে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘রেনু কিছু খাবার দিয়ে গেছে-কি করে একলা খেতে পারি? কই মাছ খেতে আমি ভালবাসতাম, তাই ভেজে দিয়েছে। কয়েকটা মাছ পাকিয়ে দিয়েছে, মুরগির রোস্ট, এগুলি খাবে কে? কিছু কিছু খেয়ে বিলিয়ে দিলাম কয়েদিদের মধ্যে। তারা কত খুশি এই জিনিস খেয়ে। কেহ বলে, সাত বৎসর কেহ বা পাঁচ বৎসর, কেহ বা তিন বৎসর এই জেলে একঘেয়ে খাওয়া খেয়ে বেঁচে আছে।’
একই বইয়ে এই প্রসঙ্গে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম। জেলখানায় আমার জন্য কাজ করবে, আমার জন্য পাক করবে, আমার সাথে এক পাক হবে না! আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সামন্তবাদ ছিল, তখনও জমিদার তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ যখন সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে, সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।’
বঙ্গবন্ধু এভাবে মানুষের অধিকারের জায়গা মূল্যায়ণ করেছেন। মানুষকে শোষণের বঞ্চনাকে তিনি ‘ভয়াবহ’ শব্দ দিয়ে যাচাই করেছেন। দুঃখী মানুষের এই বঞ্চনা তাঁর মানবিক চেতনার কাছে ধিকৃত হয়েছে। এভাবে তিনি মানুষকে দেখেছেন আপন বোধের আলোয়। ড. নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর ‘শেখ মুজিব : একটি সংগ্রাম একটি অনন্য ব্যক্তিত্ব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘এই বজ্রকণ্ঠের ব্যক্তিত্বের অপর দিকে দেখেছি কুসুমের কোমলতা, সেখানে জাতির নায়ক নেই, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নেই, আছেন সকলের সদালাপী, মিষ্টভাষী স্নেহবৎসল মুজিব ভাই, মুজিব ভাই সবার আপন, সেখানে ছোট-বড় ভেদাভেদ নেই, নেই ধনী-দরিদ্র পণ্ডিত মূর্খের ব্যবধান।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন দর্শনের আলোকে মানুষের অধিকারের কথা নিজে অবলীলায় উচ্চারণ করেন, ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’ এই আদর্শগত ভিত্তি থেকে তিনি জাতির পিতা। বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা, চেতনার স্বপ্নপরুষ। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ‘জননায়কের আবির্ভাব ও তিরোধান’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয় অনেক সময় ধরে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় থেকে তাঁকে অপসারণ করা যায়নি।’ তাই আমি বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু বাঙালির চেতনায় ও ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
সেলিনা হোেসেন: কথা সাহিত্যিক, সভাপতি, বাংলা একাডেমি
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে