Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও ভুট্টোর খায়েশ

Rahat  Minhaz

রাহাত মিনহাজ

বুধবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৪

ক্যামব্রিজের ছাত্রী অষ্টাদশী কন্যা বেনজীরকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর। জাতিসংঘের নিরাপত্তার পরিষদের টেবিলে কূটনৈতিক কূটচালে লজ্জাজনক পরাজয় ঠেকানোই ছিল তার মূল লক্ষ্য। পরবর্তী কয়েক দিন অধিবেশন কক্ষে নানা নাটক করলেও কোনো ফল হয়নি। রণাঙ্গনে লজ্জাজনক পরাজয় ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার মাত্র। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে ১৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন ভুট্টো। যাতে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েন। উত্তেজিত ভুট্টো বলেন, ‘We will fight for a thousand years... India is intoxicated today with its military successes... So you will see... this is the beginning of the road... Today, it is Pakistan... I will not be a party to it. We will fight; we will go back and fight. My country beckons me.’ পরিষদ কক্ষে হুঙ্কার দিলেও ভুট্টোকে রণাঙ্গনে যেতে হয়নি। তার আগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে এ কে নিয়াজী। এরপর ১৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডা যান ভুট্টো। সেখানে এক সামুদ্রিক ইয়ট-এ অবকাশ কাটাচ্ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। সেখান থেকেই পাকিস্তানের পথ ধরেন ভুট্টো। ১৮ ডিসেম্বর পৌঁছান বিভক্ত খণ্ডিত পাকিস্তানে।

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে তখন চরম উত্তেজনা। চিরশত্রু ভারতের কাছে লজ্জাজনক পরাজয় আর ভূখণ্ড হারানোর ক্ষোভ, হতাশা চারদিকে। ক্ষোভের উত্তাপ ছিল ৯০,০০০ পাকিস্তানি সেনা ও অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়ে বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করা এ.কে. নিয়াজীর শহর মিয়ানওয়ালিতেও। আর ওই শহরের এক কারাগারে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চারদিকে পরাজয়ের গ্লানি ও চাপা উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে মিয়ানওয়ালির ওই কারাগার তখন বঙ্গবন্ধুর জন্য আর নিরাপদ ছিল না। আর সে জন্যই জেল সুপারের পরামর্শ আর উচ্চ পদস্থদের নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুকে ওই কারাগার থেকে স্থানান্তর করা হয় শিহালা রেস্ট হাউসে। সেখানে নিরাপত্তা ছিল বেশ ভালো। ওই নিরাপদ বিশ্রাম কেন্দ্রেই ২৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন পাকিস্তানের নয়া রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৮ ডিসেম্বর দেশে ফেরার পর অভ্যন্তরীণ এক অভ্যুত্থানে ইয়াহিয়া ক্ষমতাচ্যুত ও গৃহবন্দি হন। সেনা কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় বসেন ভুট্টো। একই সঙ্গে তিনি দায়িত্ব নেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকেরও। ভুট্টোই প্রথম পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিক, যিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার গৌরব! অর্জন করেন। শিহালা রেস্ট হাউসে পৌঁছে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে জানান তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তা শুনে বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বলেন, ‘তুমি কি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হও? জাতীয় পরিষদে আমি তো তোমার দ্বিগুণ আসন পেয়েছি।’ চতুর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর শ্লেষ মেনে নিয়ে বলেন, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি এর যোগ্য নই। আপনি চাইলেই রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। প্রতি উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তার দরকার নেই। আমি তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে ফিরতে চাই, তুমি তার ব্যবস্থা কর।’ ভুট্টো জানান এই ব্যবস্থা করতে কয়েক দিন সময় লাগবে। এদিকে ওই বিশ্রাম কেন্দ্রে আনা হয় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোগী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে। ড. কামাল ও বঙ্গবন্ধু মিলে তখন একটা রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের খবর জানান চেষ্টা করেন।

২৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার পর ভুট্টো বসে থাকেননি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি। এক. ভারতে বন্দি ৯৩ হাজার যুদ্ধ বন্দির দেশে ফেরানো। দুই. যে কোনো মূল্যে, যে কোনো কাঠামোয় পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা। এই দুই লক্ষ্য অর্জনে ভুট্টো সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। যাতে তার সহযোগী ছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা আজিজ আহমেদ। ভুট্টোর পর শিহালা রেস্ট হাউসে আসেন এই আজিজ আহমেদ। তিনি জানান জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করাচিতে এক সমাবেশে ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন। পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের কোনো বিমানে করেই শেখ মুজিবকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে; কিন্তু তখনো পাকিস্তানি উড়োজাহাজগুলো ভারতের আকাশে নিষিদ্ধ। তাই তারা ফেরার পথ পরিকল্পনা করে তেহরান হয়ে ঢাকা ফেরার। তবে বঙ্গবন্ধু এই পরিকল্পনাতে রাজি হননি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন এতে তার ওপর আলাদা চাপ তৈরির সুযোগ পেতে পারেন ভুট্টো। শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন তার ট্রানজিট হোক কোনো নিরপেক্ষ দেশ। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা অথবা অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা। আলোচনার এক পর্যায়ে লন্ডনকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু এটা মেনে নেন। কারণ এরই মধ্যেই তিনি জেনেছেন লন্ডন থেকে বাঙালিরা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য বিশ্ব জনমত তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। শিহালা রেস্ট হাউসে আজিজ আহমদের কথা থেকে এটা চূড়ান্ত হয় যে ৭ জানুয়ারি রাতে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করবেন শেখ মুজিবুর রহমান।

পাকিস্তান ছাড়ার আগে চতুর ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। শিহালা গেস্ট হাউস থেকে বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগী ড. কামাল হোসেনকে নেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির অতিথি ভবনে। ওই নৈশভোজে পৌঁছে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর কাছে কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করেন পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। বলা যায় ওই সময় ভুট্টো বেশ পীড়াপীড়ি করেন। বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, এ বিষয়ে তিনি বাংলাদেশে পৌঁছে সিদ্ধান্ত জানাবেন। তার আগে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়। শেষ মুহূর্তে চতুর ভুট্টো আরও ছলচাতুরির আশ্রয় নেন। তিনি জানান আপনার (বঙ্গবন্ধুর) যাত্রা আগামীকাল সকাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। কারণ ইরানের শাহ আগামীকাল সকালে করাচি পৌঁছাবেন। তার সঙ্গে একটা বৈঠক শেষেই পাকিস্তান ত্যাগ করতে পারবেন শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরণের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চাপ প্রয়োগ করতেই শাহ সঙ্গে বৈঠক করাতে চাচ্ছে ভুট্টো। এবার তিনি তেহরান হয়ে তার ঢাকা পৌঁছানোর পরিকল্পনার কথা আরও পরিষ্কার বুঝতে পারলেন। শেখ মুজিব শক্ত হলেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই না। তুমি চাইলে আমাকে আবার কারাগারে পাঠাতে পার।’ এতে ভুট্টো নরম হতে বাধ্য হয়। পরে বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে জানানো হয়, আজ রাতেই (৭ জানুয়ারি) তারা করাচী ত্যাগ করছেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে বিমান পর্যন্ত পৌঁছে দেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। অন্তরে গোপন ইচ্ছা, কোনো না কোনো কাঠামোয় টিকিয়ে রাখা যায় পেয়ারা পাকিস্তান!

এরপর লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৯ মাসে বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘৃণ্য অপরাধ সম্পর্কে জেনে নেন। বর্বর হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, নির্বিচার নারী ধর্ষণ আর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনাগুলো শেখ মুজিব লন্ডনেই শোনেন। দেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে ভুট্টোর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের দেশ নিয়ে সুখে থাক। বাংলার মাটিতে তোমরা যে ঘৃণ্য অপরাধ করেছ, তারপর তোমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক (কনফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রী কোনো কাঠামো) থাকতে পারে না।’ সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে চূড়ান্ত ঘোষণা দিলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্ত শেখ মুজিব আগেই নিয়েছিলেন। লন্ডনে অবতরণ করার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা নাসিম আহমেদ বিমানবন্দরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে। বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘স্যার, আপনার (শেখ মুজিব) জন্য আমি কি করতে পারি? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন ‘তোমরা আমার জন্য অনেক করেছ। অসংখ্য ধন্যবাদ!’
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ