ব্রাজিলে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৬০ শতাংশ
বাংলাদেশ এক উদীয়মান অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ অঞ্চলে। করোনা মহামারিকে সামাল দিয়েও কয়েক বছর ধরে দেশটি তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবিচল রাখার ক্যারিশমা দেখাচ্ছে। আর তাই ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা দক্ষিণ এশীয় এ দেশটির সঙ্গে বহুমুখী সম্পর্ক, বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ কৌশলেরই অংশ হিসেবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সুসংহত করতে ল্যাটিন আমেরিকার এ দেশটির এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে।
ল্যাটিন আমেরিকায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার ব্রাজিল। এরই মাঝে দেশটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি গত অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ৬০ শতাংশের মতো বেড়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে তা জানা যায়।
২০২১-২২ অর্থবছরে ব্রাজিলে ১০৯ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। দেশটিতে পাঠানো পণ্যগুলোর মধ্যে মূলত ছিল জার্সি, পুলওভার, কার্ডিগান, ওয়েস্টকোট ও একই ধরনের পণ্য (নিটেড বা ক্রোশেড), পুরুষ বা কম বয়সী ছেলেদের শার্ট (নিটেড বা ক্রোশেড নয়), স্যুট, এনসেম্বেল, জ্যাকেট, ব্লেজার, ট্রাউজার, বিব অ্যান্ড ব্রেস ওভারঅল, পুরুষ বা কম বয়সী ছেলেদের ব্রিচেজ ও শর্টস (সাঁতারের পোশাক থেকে ভিন্ন এবং নিটেড বা ক্রোশেড নয়)।
১৯৯৫-২০২০ সালের মধ্যে ব্রাজিলে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিবছরে ৯ দশমিক শূন্য আট শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ১৯৯৫ সালে ১৫ দশমিক এক মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২০ সালে ১৩২ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ব্রাজিলও ২ হাজার ২৪৫ দশমিক এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করে। এর মধ্যে ছিল আখ বা বিটের চিনি ও রাসায়নিকভাবে বিশুদ্ধ সুক্রোজ (কঠিন অবস্থায়), তুলা (কার্ডেড বা কম্বড অবস্থায় নয়) এবং সয়াবিন (ভাঙা কিংবা আস্ত আকারে)।
ব্রাজিলের প্রতিনিধিদলটি আসার আগে সেখানে বাংলাদেশের দূত সাদিয়া ফয়জুন্নেসা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি ওই প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে আসার কথা এবং দুদেশের মাঝে বাণিজ্য বাড়াতে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সদিচ্ছার কথা জানান।
ইতিমধ্যে ঢাকার ব্রাজিল দূতাবাস তৎপর হয়ে ওঠে। তারা গত মে মাসে ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য উন্নয়ন বিভাগ, ইনভেস্টমেন্ট অ্যাট্রাকশন (ডিপিআরএ), ব্রাজিলিয়ান ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি (অ্যাপেক্স-ব্রাজিল) এবং ব্রাজিল-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিবিসিসিআই) সহায়তায় রাজধানীতে 'ব্রাজিল-বাংলাদেশ ট্রেড কনফারেন্স' শিরোনামে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ ছাড়া বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন এবং নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীরা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করবে না। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে পরবর্তীকালে দেশটি (বাংলাদেশ) এক নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এসব কথা বলেন বাংলাদেশে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত পাওলো ফার্নান্দোস ডায়াস ফেরেস। ব্রাজিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ তুলা উৎপাদনকারী এবং একই সঙ্গে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারকের তকমা পেয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তুলা আমদানিকারক দেশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে ব্রাজিলের জিডিপি ছিল নিম্নতম, এক দশমিক ৮৩৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৮ হাজার ৫৭০ ডলার। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মাঝে শীর্ষ দশে থাকার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ব্রাজিলের। দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে বেশ ভরপুর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, ২০২২-২৩-এ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যতটা আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে কিছুটা নিম্নমুখী ছিল। মুদ্রাস্ফীতির উল্লম্ফন, রপ্তানি ও বৈদেশিক আয়ে ধীরগতি এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চলমান সংকট এর কারণ বলে এক বিশ্লেষণে উঠে আসে।
বিবিএস-এর প্রাথমিক অনুমানের ভিত্তিতে জানা যায়, গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি ছয় দশমিক শূন্য তিন শতাংশ বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল সাত দশমিক এক শতাংশ। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে পরবর্তীতে অর্থনীতির প্রবাহ কিছুটা কমে আসতে শুরু করে।
সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভার পর পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এসব তথ্য তুলে ধরেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী প্রফেসর শামসুল আলম।
তবে বিবিএস-এর অনুমাননির্ভর এই হিসাবের চেয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও কম হবে বলে ধারণা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর। এর মধ্যে আইএমএফ মনে করে, গেল অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশের বেশি হবে না।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধ্বে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে এ হিসাব দেয় বিবিএস এবং তা সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশের চেয়ে কম ছিল।
জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দুবার সংশোধনীর মাধ্যমে হ্রাস করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় ছিল বিরাজমান অর্থনৈতিক অস্থীতিশীলতা।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, ব্রাজিল এবং মারকোসার-এর অন্য তিন সদস্য দেশ আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে এবং উরুগুয়ের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জোর প্রচেষ্টার অনুরোধ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ ও ব্রাজিলের মধ্যে কৃষিতে সহায়তামূলক পদক্ষেপকে শক্তিশালী করে তোলার অনুরোধও জানানো হয়। ব্রাজিলিয়ান প্রতিনিধিদলের এ সফরকে ফলপ্রসূ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ঢাকায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরতদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগাযোগ করা হয়।
এক চিঠিতে রাষ্ট্রদূত সাদিয়া ফয়জুন্নেসা বলেন, ব্রাজিলে অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে পারানা প্রদেশ, যার জিডিপি এক দশমিক সাত ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেখানেই রয়েছে দেশটির দ্বিতীয় বৃহৎ কার্গো বন্দর।
মারকোসারের দেশগুলোর বাজারে প্রবেশের মধ্যস্থতায় ক্রিয়াশীল রয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এতে সফল হলে এ দেশের সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্য নতুন স্তরে উপনীত হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রয়াসে ব্রাজিল এবং মারকোসার-এর সদস্যদের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ চুক্তি বাস্তবায়ন অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই চুক্তিগুলো দেশের ওষুধশিল্পের সামনে অপার সুযোগের দ্বার অবারিত হবে।
ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে পারানার গভর্নর, ইনভেস্টা পারানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং অন্যান্য কয়েকটি খাতের ব্যবসায়ী নেতারা ঢাকা সফরে তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নয়া গন্তব্য হতে পারে লাতিন আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বের ১২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল।
গত বছরের জুনে পারানা সফর করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাদিয়া ফয়জুন্নেসা। সেখানে তিনি পারানার প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক শাখার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের সামনে বাংলাদেশে প্রতিশ্রুতিশীল এবং আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন।
তবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও বিনিয়োগের সুবিধা সম্পর্কে খুব কমই জানে ব্রাজিল, বলেন তিনি।
পারানা প্রদেশের পারানাগুয়ায় অবস্থিত ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহৎ কার্গো বন্দর সান্তোস। মারকোসার-এর সদস্য দেশগুলোতে পণ্য পরিবহনেও এই বন্দর গুরুত্বের শীর্ষে।
সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্যে গতি দিতে বাংলাদেশ এই মারকোসার-এর সদস্যদের বাজারে প্রবেশে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই মধ্যস্থতা সফল হলে রপ্তানি খাতে নতুন দিগন্তের যে সূচনা হবে, তা বলাই বাহুল্য।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে