মিয়ানমার ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতার দিকে যাচ্ছে। পশ্চিমা কাঠামোর আলোকে যে ধরনের রাষ্ট্রকে আমরা আধুনিক রাষ্ট্র বলে থাকি, মিয়ানমার সেই অর্থে আধুনিক এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। মিয়ানমার অনেকটাই ফ্লুইড রাষ্ট্র। মিয়ানমার এমন একটি দেশ যেখানে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং সংঘাত সব সময়ই ছিল। কখনো বেশি কখনো হয়তো কিছুটা কম; কিন্তু রাষ্ট্রটি সব সময়ই নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে গেছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে-কাঠামোতে গড়ে ওঠে মিয়ানমার সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। মিয়ানমারের জনগণ দেশটিকে একক জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। সেখানে কারেন, কুকি, চীন, ওয়াহ ইত্যাদি জনগোষ্ঠী সব সময়ই আন্তঃকলহে লিপ্ত রয়েছে। একটি বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, সংঘাত সৃষ্টিকারী এসব গোষ্ঠী কিন্তু কখনোই তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা চায়নি। তারা বরং স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে চাচ্ছে। রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তি রাজস্ব সংগ্রহ, সেখানেও সংঘাতরত গোষ্ঠীগুলো অংশীদারত্ব দাবি করে আসছে।
এমনই এক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে মিয়ানমারে বর্তমানে যে সংঘাত ছড়াচ্ছে তাকে আমি অস্বাভাবিক কিছু মনে করি না। এ ধরনের সংঘাতের মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আবার শক্তি সঞ্চার হয়। এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিকার করে থাকার একটি যুক্তি তৈরি হয়। কারণ দেশে যদি পরিপূর্ণ শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় থাকে তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে সেনাবাহিনী কেন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। সেই অবস্থায় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের দাবি জোরদার হতে পারে। কাজেই সেনাবাহিনীও চায় না যে, দেশে নিরন্তর শান্তি বিরাজ করুক। বরং তারা সীমিত পরিসরে সংঘাত কামনা করে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব প্রয়োজনেই সীমিত পরিসরে সংঘাত বিদ্যমান থাকা জরুরি। অনেকেই মনে করেন, সব দেশই শান্তি কামনা করে; কিন্তু বিষয়টি তা নয়। অনেক দেশে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন থাকে তারা সংঘাতময় পরিস্থিতি কামনা করে, কারণ এতে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। যদি সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারে তাহলে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হয়, যা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনার সময় কমিশন বাণিজ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীও সে ধরনের একটি কাঠামো তৈরি করেছে। ফলে মিয়ানমারে জাতিগত সশস্ত্র সংঘাত সহসাই কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এখন প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারে যে জাতিগত সশস্ত্র সংঘাত চলছে তার ফলে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে বা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে? এর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের ভয়ে রোহিঙ্গাদের একটি বিরাট অংশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় ৬ বছর ধরে তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কোনো স্বাধীন দেশই চাইতে পারে না অন্য কোনো দেশের উদ্বাস্তুরা তার দেশে দিনের পর দিন অবস্থান করুক। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের ব্যাপকতা এবং গভীরতা অনেকটাই বেড়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য বিদ্রোহীদের তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই ঘটনা শুধু যে বাংলাদেশের সীমান্তেই হয়েছে তা নয়। ভারত এবং চীনের সীমান্তেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা অবশ্যই অনুধাবন করা যাচ্ছে। যদি মিয়ানমারের জাতিগত সংঘাত আরও ব্যাপকতা লাভ করে তাহলে আবারও সেদেশের উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশে আসতে পারে। প্রত্যেকটি সংকট কিছু সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। মিয়ানমারে বর্তমানে যে জাতিগত সংঘাত চলছে তা আমাদের জন্য কিছু সুযোগও তৈরি করেছে। এখন আমরা চাইলে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলাপ আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি। আমরা চাইলে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারি। এমন কি পরিস্থিতির বিষয়টি জাতিসংঘেও উত্থাপন করতে পারি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই বার্মা অ্যাক্ট নামে একটি অ্যাক্ট অনুমোদন করেছে। এই অ্যাক্টের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশেষ কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন মিয়ানমারে সংঘাতরত কোনো গোষ্ঠীকে সহায়তা দেবেন তাহলে তা তিনি দিতে পারবেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে দেয়া এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন কি না তা সময়ই বলতে পারবে। তবে এটা নিশ্চিত যে মিয়ানমারের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। মিয়ানমার ইস্যুতে শুধু যে সংশ্লিষ্ট দেশটিতেই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা নয়। একই সঙ্গে ভারত এবং চীনের সঙ্গে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। উপরন্তু দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ আগামীতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হয়তো বহুমাত্রিকতা লাভ করতে পারে।
এই অবস্থায় নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমার ইস্যু নিয়ে বসতে পারে। বিশেষ করে ভারত এবং চীনের সঙ্গে এই ইস্যু নিয়ে আলোচনায় বসা যেতে পারে। মিয়ানমার পরিস্থিতিতে ভারত এবং চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি মিয়ানমারের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে তাহলে তা কোনোভাবেই চীন বা ভারতের স্বার্থের অনুকূল হবে না। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশগুলোকে সম্মত করানোর ব্যাপারে অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশ ভারত এবং চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসার পাশাপাশি মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে। তাদের বুঝানো যেতে পারে ভবিষ্যতে মিয়ানমার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এবং এক সময় মিয়ানমার পরিস্থিতি তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে সামরিক প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আগেই সেই প্রযুক্তি দিয়ে নতুন প্রযুক্তিকে মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ইউক্রেনে যে মার্কিন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে তার একটি অংশ যদি মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠীর হাতে এসে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কাজেই মিয়ানমার বাহিনীকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে।
আন্তর্জাতিক আদালতের একটি সাময়িক জাজমেন্ট আছে মিয়ানমারের ব্যাপারে। সেই জাজমেন্টে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে আছেন তাদের ওপর যেন নতুন করে আর কোনো আক্রমণ পরিচালনা করা না হয়। আমি বিশ্বাস করি, মিয়ানমার সরকার এ ব্যাপারে সচেতন আছেন, যাতে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে কোনো সামরিক আক্রমণ চালানো না হয়। মিয়ানমারের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। চীন, ভারত, মিয়ানমার এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে মিয়ানমার ইস্যুতে আলোচনা শুরুর পাশাপাশি আরো বৃহত্তর পরিসরে ইস্যুটি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে বেশ কিছু শেল এসে পড়েছে। কয়েকজন নিরীহ মানুষ আহত হয়েছেন। এবং ইতোমধ্যে দুজন মারা গেছেন। তাই ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য জাতিসংঘে উত্থাপন করা যেতে পারে। মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশের বড় আকারে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ২০ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক জিনিস নয়।
বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি, মিয়ানমার ইস্যুতে কাজ করার জন্য কাউকে পূর্ণকালীন দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের সময় যেমন অ্যাডমিরাল খুরশিদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। মিয়ানমার ইস্যুতেও তেমনি কাউকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে মিয়ানমার ইস্যু ডিল করার জন্য আলাদা একটি অনুবিভাগ খোলা যেতে পারে। যে বিভাগ থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিভিন্ন পর্যায়ে তুলে ধরা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকেন যে তার পক্ষে একটি মাত্র ইস্যুতে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। মিয়ানমার ইস্যুতে পৃথক একটি বিভাগ গঠন করা হলে সেই বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে ইস্যুটি উত্থাপন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ইস্যুটিকে জাতিসংঘে উত্থাপনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়া যাবে।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে