Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বিশ্বব্যাংকের খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশ ‘লাল’ তালিকায়

M A  Khaleque

এম এ খালেক

সোমবার, ৫ আগস্ট ২০২৪

বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় স্থানপ্রাপ্ত দেশগুলোর ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ উত্তর বিশ্ব উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব প্রত্যক্ষ করে। বিশ্বের এমন একটি দেশও ছিল না, যারা এই সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা মোকাবিলা করেনি। সার্বিকভাবে প্রতিটি দেশই উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নাজেহাল হয়ে পড়েছিল। এক পর্যাযে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর মূল্যস্ফীতি হার দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা ছিল দেশটির বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী স্প্লাই চেইন ভেঙে পড়ার কারণেই মূলত মূল্যস্ফীতি এতটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) পরিসি রেট বাড়ানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) গত ২ বছরের মধ্যে অন্তত ১৩ বার পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। পলিসি রেট বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগে কার্যক্রমে মন্থর হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) পলিসি রেট বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে গণদুর্ভোগ কমানোর লক্ষ্যে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরও অন্তত ৭৬টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট আগে ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি এবং আরো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদেও অর্থনীতিতে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩ দশমিক ২ শতাংশ। এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যাগ্রস্থ অর্থনীতিতেও মূল্যস্ফীতি ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশে চলে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকগুলোকে স্বল্পকালীন ধার বা ঋণদানের ক্ষেত্রে যে সুদ আরোপ করে সেটাই পলিসি রেট। আর সিডিউল ব্যাংকগুলো সাধারণ ঋণ গ্রহীতা বা উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে যে সুদ চার্জ করে সেটাই ব্যাংক ঋণের সুদের হার। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র হচ্ছে এই রকম- কোনো কারণে পলিসি রেট বৃদ্ধি পেলে সিডিউল ব্যাংকগুলোর ‘কস্ট অব ফান্ড’ বৃদ্ধি পায়। কাজেই তারা যখন উদ্যোক্তা পর্যায়ে ঋণদান করে তখন আগের তুলনায় হারে সুদ চার্জ করে। এতে সাধারণ ঋণ গ্রহীতা বা উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণের আগ্রহ কমে যায়। এতে বাজারে অর্থের যোগান হ্রাস পায়। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা রোধ করতে পারলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। তার কারণে হলো বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বারবার বৃদ্ধি করলেও কিছু দিন আগ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে রেখেছিল। ফলে ব্যক্তি বা উদ্যোক্তা পর্যায়ে ব্যাংক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা হ্রাস না পেয়ে বরং আরো বৃদ্ধি পায়।

এই অবস্থায় গড় প্রায় ২ বছর ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব বয়ে চলেছে। বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশের খাদ্য পণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতার ভিত্তিতে যে রেটিং করেছে সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা ভালো নয়। বিশ্বব্যাংক কিছু সিলেক্টিভ দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশের কম এমন দেশগুলোকে সবুজ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোট দুটি দেশকে সবুজ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খাদ্য পণ্যেও মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৫ শতাংশ এমন দেশগুলোকে হলুদ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোট ২টি দেশ হলুদ শ্রেণির আওতায় পড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৩০ শতাংশ এমন দেশগুলোকে ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ মোট ১৫টি দেশ এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশের বেশি তাদের বেগুনি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোট ৮টি দেশ এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মোট ১৭২টি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই বাংলাদেশের খাদ্য পণ্যেও মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের উপরে ছিল। এর মধ্যে আগষ্ট ২০২৩ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অক্টোবর মাসে ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। নভেম্বর মাসে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পরবর্তী কয়েক মাসে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এলেও গত এপ্রিল মাসে তা আবার ১০ দশমিক ২২ শতাংশে উন্নীত হয়। মে মাসে তা ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং জুন মাসে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে যে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বাস্তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি। খাদ্য মূল্যস্ফীতির উচ্চ প্রবণতার কারণে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা দিন এনে দিন খায় নিম্ন আয়ের মানুষগুলো বড়ই বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।

এ ছাড়া অন্যান্য অনেক পেশায় বেতন-ভাতা যেভাবে বৃদ্ধি পায় তার চেয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ফলে মানুষের রিয়েল ইনকাম ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সাধারণভাবে বাংলাদেশের মানুষ তাদের মোট আয়ের অর্ধেকই ব্যয় করে থাকে খাদ্য পণ্য ক্রয় বাবদ। আর নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষগুলো তাদের মোট আয়ের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ব্যয় করেন খাদ্য পণ্য ক্রয় করার জন্য। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ যা বিগত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে অন্তত ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। খাদ্য নিরাপত্তা হীনতায় থাকার কারণে মানুষ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খাদ্য হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। খাদ্য ছাড়া আমাদের একদিনও চলে না।

বাংলাদেশ অতীত কাল থেকেই খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। প্রশ্ন হলো, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ তাহলে কেনো খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকবে? ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন দেশে খাদ্য চালের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন চালের উৎপাদন বেড়ে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪গুন। আর একই সময়ে জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে ১৭ কোটিতে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় আড়াই গুণ। তাহলে বাংলাদেশ কেনো খাদ্য নিরাপত্তহীনতায় ভুগবে? বিগত বছরগুলোতে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য এসেছে। আগে সাধারণত মানুষ খাবার হিসেবে ভাত গ্রহণ করত। এখন ভাতের পাশাপাশি রুটি এবং অন্যান্য খাবারও গ্রহণ করছে। অনেকের নিকট ‘ফাস্ট ফুড’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। তারা সাধারণ খাদ্যের বিকল্প অথবা পরিপূরক হিসেবে ফাস্ট ফুড গ্রহণ করছেন। সরকার নানাভাবে খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করে চলেছেন। কৃষি খাতে ব্যাপক পরিমাণে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ কৃষি খাতে ভর্তুকি বন্ধ করা অথবা ব্যাপক মাত্রায় কমানোর জন্য একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছে; কিন্তু সরকার কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে কৃষি খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করেনি। এর ফল আমরা হাতে হাতেই পাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। সামান্য কিছু চাল এবং গম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়েও বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্যের জন্য কারও কাছ ধরনা দিতে হয় না। অনেকের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে ২০০৭-০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সৃষ্ট মন্দার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য পণ্যের প্রচণ্ড অভাব দেখা দিয়েছিল। সেই সময় আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে খাদ্য সংগ্রহকালে ভোক্তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছিল; কিন্তু বাংলাদেশ সেই অবস্থাতেও মোটামুটি নিরাপদ ছিল খাদ্যের জোগানদানের ক্ষেত্রে।

কিন্তু এখন খাদ্য পণ্য সংগ্রহ করতে সাধারণ মানুষকে এতটা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কেন? দেশে খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি মোটামুটি ঠিকই আছে; কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থা মোটেও ঠিক নেই। ফলে উৎপাদিত খাদ্য পণ্য সঠিক এবং স্বল্প সময়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী খাদ্য পণ্য আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধি করছে। মজুতদারদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক ভাবে সরকারি দলে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকেন। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণকারি সংস্থা চাইলেও এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করছে। অথবা কথাটি এভাবেও বলা যায়, খাদ্য সংকটের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে। গত দুবছর ধরে খাদ্য পণ্যেও মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের ওপরে থাকছে। এমনকি ১২ শতাংশ অতিক্রম করে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করার মতো তাহলো, মূল্যস্ফীতি এবং মানুষের প্রকৃত আয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকা। পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পেলেও কোনো অসুবিধা নেই যদি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার রিয়েল ইনকাম বা প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায়। যেমন এক হালি ডিমের দাম যদি এক বছরের ব্যবধানে ৪০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ টাকা হয় তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই যদি আমার প্রকৃত আয় একই সময়ে ৪০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তার প্রকৃত আয় বা রিয়েল ইনকাম; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের প্রকৃত আয় বা রিয়েল ইনকাম সেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না। ফলে মানুষের ক্ষয় ক্ষমতা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালের মে মাসে দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির সার্বিক হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সেই একই সময়ে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির প্রকৃত হার ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। মার্চ, ২০২৪ তারিখে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। পরের মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। একজন পেনশনভোগী সরকারি কর্মকর্তার বছরে পেনশন বৃদ্ধি পায় ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায় প্রায় দ্বিগুণ। তাহলে তিনি কীভাবে চলবেন? ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক চাকরি আছে যেখানে প্রতি বছর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয় না।

মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক কমার প্রস্তাব করলে অনেকেই তেড়ে ওঠেন। তারা বলেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার ব্যাপক দরপতন ঘটবে। সেই অবস্থায় প্রতিটি আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে; কিন্তু যারা এই মতের অনুসারী তারা একবারও ভেবে দেখেন না কি কারণে বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পায়। আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি কারণেই কি স্থানীয় বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পায় নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? বাংলাদেশ তার নিত্য পণ্যের মাত্র ২৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। তাহলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কেনো বৃদ্ধি পায়? সরকার যদি সঠিক এবং কার্যকরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন তাহলে কোনোভাবেই পণ্য মূল্য এতটা বৃদ্ধি পেত না। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার যদি বাজারভিত্তিক করা হতো তাহলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় দেশে আসার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতো। রপ্তানি মূল্যের যে অংশ নানা প্রক্রিয়ায় বিদেশে থেকে যাচ্ছে তাও দেশে আসত। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট অনেকটাই কেটে যেত।

সাধারণ মানুষ খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে খুবই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে আছেন। তাদের কিছুটা স্বস্তি দেবার জন্য হলেও খাদ্য পণ্যের মূল্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের একজন অর্থনীতিবিদ, যিনি সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের যে আন্দোলন চলছে তাতে বিস্ময়করভাবে সাধারণ মানুষও যোগ দিচ্ছে। এর কারণ হলো সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। আর এই ক্ষোভের অন্যতম কারণ হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা। মানুষ পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য যে কোনো কাজ করতে পারে। তাই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সামান্য কিছু মজুতদারকে সহায়তা করার নামে দেশের জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অতএব, সাধু সাবধান।

এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ