নদী-সংক্রান্ত আইন ভারতও মানে না, বাংলাদেশও মানে না
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী ম ইনামুল হক নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে তিনি ‘জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট’-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তা ছাড়া তিনি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক। গতকাল রোববার (২৫ আগস্ট) আন্তর্জাতিক নদী আইন, নদীর নাব্য, ঐতিহাসিক নদীর অধিকার ও ডম্বুর ড্যাম নিয়ে তিনি ‘ভিউজ বাংলাদেশ’ টিমকে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: এম এ খালেক ও গিরীশ গৈরিক।
ভিউজ বাংলাদেশ: গত ২০ আগস্টের আগে এক সপ্তাহের বৃষ্টিতে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, সিলেটসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি জেলা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এবারের বন্যার সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, যেসব অঞ্চলে আগে কখনো বন্যা হয়নি, সেসব অঞ্চলের মানুষও এবার বন্যা দেখেছেন। এই বন্যার পর থেকে একটা বিষয় খুব আলোচিত হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারতের নদী আইন কতটা মান্য হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: বন্যা বেশি হয়েছে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে। ১০-১২টা জেলায়। একটানা কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে। এর কারণ হলো, মৌসুমি বায়ু যেটা দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে যায়, সেই বায়ুটা যে গতিতে চলে যায়, এটা বাধা পায় অনেক সময়। বাধা পেলে স্থানীয়ভাবে ঘনীভূত হতে থাকে। তখন বাতাসের ভেতরে থাকা জল ঝরতে থাকে। ফলে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টি হয়। যদি সরে যায়, তাহলে আর বৃষ্টি হয় না। আমরা দেখেছি যে বৃষ্টিপাতটা ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে হয়েছে। এই বৃষ্টিপাত ক্রমেই ত্রিপুরা থেকে মৌলভীবাজার, মৌলভীবাজার থেকে সিলেট হয়ে চলে যেত; কিন্তু তা না হয়ে এখানে হয়েছে।
এমনিতেও মেঘালয়ে তো অনেক বৃষ্টিপাত হয়। ওখানেও যেতে পারত; কিন্তু ওখানে না হয়ে এখানে হয়েছে। এটাকে স্থানীয় একটি নিম্নচাপ বলা যায়, যার কারণে মেঘ সামনে এগোতে পারে না, ভারী হয়ে পানিটা সব নিচে নেমে যায়। এই বন্যা হয়েছে অতিবৃষ্টির কারণে। যেসব অঞ্চলে বন্যা হয়েছে সেসব অঞ্চলে নদী আছে। নদীর প্রবাহ সবই বাংলাদেশে এসেছে। অতএব, বাংলাদেশে বন্যা হয়েছে। বাংলাদেশেও বৃষ্টিপাত হয়েছে; কিন্তু বেশি বৃষ্টি হয়েছে ওখানে। পানিটা এখানে এসেছে, ফলে একটা রব উঠেছে যে, ভারত তার গেট ছেড়ে দিয়েছে। ভারতের বন্যার পানি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। কীভাবে চাপাবে? শুধু যে নদী দিয়ে পানি এসেছে তা না, মাঠ বয়েও এসেছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এসেছে; কিন্তু নদীগুলো দেখা যায়, তাই আমরা বলছি যে নদীগুলো ছেড়ে দিয়েছে। তাতে প্রশ্ন আসছে, ভারত ও বাংলাদেশ কতটুকু নদী আইন মানে?
নদী আইন তো দুপক্ষই মানে না। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার আসার পরই আমি বলেছি, আন্তর্জাতিক যে নদী আইন জাতিসংঘ করেছে ১৯৯৭ সালে, সেটা মানার জন্য আমরা আন্দোলনও করেছিলাম, সেটা মেনে নিক। মেনে নিক মানে রেটিফাই করুক, রেটিফাই করলে দুই দেশই মানবে। প্রসঙ্গত বলা যায় আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে কথা। মিয়ানমারের সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরাট গোলমাল হয়েছিল, এখন সমুদ্রসীমার যে আন্তর্জাতিক আইন সেটা ভারতও মানে, বাংলাদেশও মানে, মিয়ানমারও মানে। তার মানে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারলাম। রেটিফাই করে আদালতের মাধ্যমে সমাধান হলো; কিন্তু নদী-সংক্রান্ত যে আইন আছে তা ভারতও মানে না, বাংলাদেশও মানে না।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ফেনীতে বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে এক নারী ও তার শিশু। [জাকির হোসেন চৌধুরী/এএফপি]
তাহলে আমি যাব কোথায়? আমি মুখে অনেক কথা বলতে পারি; কিন্তু আমি নিজেই আইন মানি না। নদী আইন যদি উভয় দেশ মান তো তাতেই যে উপকার হতো তা না। অতিবৃষ্টি হলে কিছুই করার উপায় নেই। বন্যা হবেই। বাংলাদেশের ভেতরে তো হয়ই, ভারতের ভেতরেও হয়। আসামে প্রায়ই বন্যা হয়। বিহারে বন্যা হয়। দুর্গাপূজার সময় যখন মৌসুমি বায়ু পিছিয়ে আসে, কার্তিক মাসের আগে, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে একটা নিম্নচাপ হয়। কলকাতা, সুন্দরবন ও খুলনাকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল বৃষ্টিপাত হয়। অতিবৃষ্টি হলে উপায়ই নেই। বন্যা হবেই। বাংলাদেশ একটি নিচু এলাকা। বর্ষা এবং শরৎ এই দুই ঋতুতে বন্যা হবেই। বাংলাদেশের যে এলাকা তার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি পানি এই এলাকার ওপর দিয়ে যায়, তাহলে বন্যা তো হবেই।
আমাদের তো বন্যার সঙ্গেই বসবাস। ছোট থাকতেই আমরা সাঁতার শিখে যেতাম। মা-বাবা দেখত ছোট থাকতেই আমরা ভেলায় চরে বিলের মধ্যে চলে যেতাম। আমরা কত ধরনের মাছটাছ ধরতাম, কী আনন্দের ব্যাপার ছিল! শাপলা ছিঁড়ে নিয়ে, শালুক তুলে নিয়ে খেতাম। এখনো তো আমার মুখে সেই স্বাদ লেগে আছে; কিন্তু এখন আমাদের শহরের ছেলেপুলেরা তো জানে না এসব। আর বাংলাদেশের এখন অর্ধেক শহর হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ-রাস্তাঘাট সব হয়ে যাওয়াতে অর্ধেক শহর হয়ে গেছে, পুকুর-ডোবা সব ভরে গেছে, বুঁজে গেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা সাঁতার জানে না। নদীনালা-বন্যা কী জানে না। তাই তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়। বর্তমান প্রজন্ম তো এই বন্যা নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত। ছোটবেলায় আমরা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম না, এটা আনন্দের বিষয় ছিল।
অতিবৃষ্টি হলে মাছগুলো লাফিয়ে ডাঙার দিকে উঠত, বিশেষ করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। আমরা হাত দিয়ে ধরতাম। কী মজার ব্যাপার। এখনো আমার স্মরণে আছে। আরেকটি বিষয় হলো, বন্যা ফেনী দিয়ে শুরু হয়েছে। মানচিত্রে কেউ যদি জেলাটা দেখে, দেখবে যে কেমন যেন উঁচু জায়গাটা, এই উঁচু জায়গাটা পরশুরাম আর ফুলগাজী থানায়। তার একটু দক্ষিণে ছাগলনাইয়া থানা। একপাশে ফেনী সদর থানা। এই পরশুরাম আর ফুলগাজী থানা যে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে, ওইসব এলাকার লোকজন জানে এর আগে পাহাড়, পশ্চিমে পাহাড়। পূর্বেও ভারত, পশ্চিমেও ভারত। পাহাড় মানে খুব উঁচু পাহাড় না, টিলার মতো। পাহাড়ের মাঝখানে এই জনপদ নিচু এলাকা। উত্তরে মুহুরী নদী। এটা ভারতের দক্ষিণের কিছু অঞ্চল থেকে পানি নিয়ে মহুরী নদী দিয়ে প্রবেশ করে। নিচু এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে দক্ষিণের সোনাগাজীর দিকে যায়। তাতে তো অল্পবিস্তর বন্যা হয়ই। প্রতিবছরই ওসব অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা থাকে। প্রায়ই একটু-আধটু বন্যা হয়। ওসব অঞ্চলে সেসব নদী আছে, সিলোনিয়া, মুহুরী আর কহুয়া-তিনটি নদী আছে। তা ছাড়া দুপাশের পাহাড় থেকে নানা ছড়া বেরিয়ে এসেছে। এই তিনটিই মূল নদী। এই তিনটি নদীর দুপাশে মাটির বাঁধ আছে। এই মাটির বাঁধ অল্প বন্যাকে ঠেকাতে পারে। একটু বড় বন্যা হলেই মাটির বাঁধ হয়তো উপচে যায়, না-হলে ভেঙে যায় এবং বন্যার সৃষ্টি করে ফেনী এলাকাতে। এবার একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অতিমাত্রায় বন্যা হয়েছে। ফুলগাজীর একজন বলল, ইনাম ভাই, আমার বাড়ি তো ডুবে গেছে। আমি বললাম, এত বৃষ্টি হয়েছে, বাড়ি তো ডুববেই। বলল কেন এরকম হলো? আমি বললাম, দেখো, তোমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে পাহাড়, পূর্ব দিকে পাহাড়, তাহলে পানিটা সরবে কোথায়? বলে, আহা, ঠিকই বলেছেন তো। নিচু এলাকা, ওখানে অতিবৃষ্টি হলে বন্যা হবেই। প্রতি বছরই অল্প-বিস্তর বন্যা হয়। এই হলো ব্যাপার আর কী।
ভিউজ বাংলাদেশ: নদী ভরাট হয়ে যাওয়াটা বা নাব্য সংকট কতটা দায়ী এই বন্যার জন্য?
প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: দুটি আলাদা প্রশ্ন। ভরাট হওয়া একটা প্রশ্ন, নাব্য আরেকটা প্রশ্ন। নদীর তলদেশ ভরাট হয় কী কারণে? এক হয় নদী ভরাট করার জন্য মানুষই হয়তো নিচু এলাকা ভরাট করে দিল। আবার কিছু কিছু নদী আছে, পলি বয়ে নিয়ে আসে। অনেক নদী আছে পলি নাই। বিশেষ করে যেসব নদী বুঁজে গেছে, অল্প স্রোত হয়, সেগুলোতে পলি নাই। যেসব নদী পাহাড় থেকে এসেছে তার পলি আছে। পলি যেখানে থাকে সেখানে ভাঙনও থাকে। এটা নদীর একটা চরিত্র, পলি এবং ভাঙন একই সঙ্গে থাকে। এখানে যেসব নদী আছে, যেসব নদী ত্রিপুরা থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই নদীগুলোতে প্রচুর পলি আসে। প্রচুর পলি এলেও, নদীর তলদেশ এমনভাবে ভরাট হয়েছে যে খুব বেশি টের পাওয়া যায় না। যেমন মুহুরী নদী; কিন্তু গোমতী নদী, যা কুমিল্লার দুঃখ হিসেবে পরিচিত, সেখানে প্রচুর পলি আসে। এক সময় সেখানে প্রতি বছরই বন্যা হতো। এখন দুটো বাঁধ দেয়া হয়েছে দুপাশে। কেউ যদি কুমিল্লা যায়, দেখবে যে বাঁপাশে একটা পাহাড় যাচ্ছে, ওটা পাহাড় না, ওটা নদীর বাঁধ। গোমতী নদীতে পলি পড়ে পড়ে তলা উঁচু হয়ে গেছে। তাই বাঁধও উঁচু হয়েছে।
ডম্বুর ড্যাম। [গোকুলম সিক আইএএস একাডেমি]
এটা শুধু আমাদের দেশে না, পৃথিবীর অনেক নদীই তলা উঁচু হয়ে যায়। যেমন, আমেরিকার মিসিসিপি নদী, উঁচু হয়ে সাগরের ভেতর ঢুকে গেছে। তলা উঁচু হয়ে যাওয়া একটা সমস্যা। তলা উঁচু না হলে পলি চারদিকের ডাঙ্গায় ছড়িয়ে যেত। মাঠ উঁচু হয়ে যেত। তাহলে ডাঙ্গা উঁচু হয়ে নদী নিচু হয়ে যেত। নদীর প্রবাহ হতো অন্যরকম। যেমন, মুরাদনগর থেকে বুড়ী নদী গেছে নবীনগরের দিকে। তার মানে গোমতী নদী আগে দাউদকান্দি হয়ে মেঘনায় গিয়ে পড়ত না, বুড়ী নদীর ওই দিকে যেত। তাই ওটাকে বুড়ী নদী বলা হয়। ওই নদীটা এখন বন্ধ। একটি স্লুইস গেট দেয়া আছে। পলিবাহিত নদীর এটা একটা বৈশিষ্ট্য। যমুনা নদীতেও প্রচুর পলি আসে; কিন্তু একটা বড় এলাকা ধরে এর বাঁধ দেয়া আছে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে বাঁধের দূরত্ব গড়ে ১২ কিলোমিটার। অথচ নদীর মূল প্রবাহ কিন্তু খুব ছোট, হয়তো দুই তিন কিলোমিটার হতে পারে; কিন্তু, নদীর ভেতরে যেহেতু প্রচুর জায়গা আছে, শাখা-প্রশাখা আছে, ছোট খাল-নালা আছে, তাই পলিটা চরে পড়ে। কিংবা বাহিত পলি বঙ্গোপসাগরে চলে যায়।
তাই সাগরেও চর জাগছে। তাই পলি যেমন নদীর চরিত্র বদল করে, আবার আমাদের জন্য উপকারী, আবার এর কারণে মাঝে মাঝে বন্যা হতে পারে। নদী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা যুক্ত, যেমন পানি উন্নায়ন বোর্ড, নদী বুঝে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নদীর সঙ্গে নৌ চলাচলের বিষয়টিও জড়িত। প্রবাহ থাকলে নৌ-চলাচল থাকবে। প্রবাহ না থাকলে তো নৌ-চলাচলও থাকবে না। নদীর প্রবাহটা জরুরি। বর্ষাকালে নদীগুলোতে দেখা যায় প্রবাহ থাকে ২৫ হাজার কিলোমিটারের ওপরে, শীতকালে সেটা নেমে এসে বড়জোর ৫ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়ায়। বাকিগুলো বন্ধ থাকে। ফলে নাব্য স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের দেশের এক অংশের মানুষ মনে করছেন এই বন্যা ডম্বুর ড্যাম ভেঙে দেয়ার কারণে হয়েছে, এটা কতটা সত্য?
প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: ভারত থেকে যে নদীগুলো এসেছ তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাঁধ হলো ফারাক্কা ব্যারাজ। এর পরে হলো তিস্তা ব্যারাজ। এর পরে যেসব ব্যারাজ আছে, সেসব ছোট ছোট। যেমন মনুতে আছে, খোয়াইতে আছে। এই যে ব্যারাজগুলো, বৃষ্টি যখন হয় কিছুটা তো ঠেকায়। বৃষ্টি যখন হয়, তখন তিস্তা ব্যারাজে যতদূর পারে পানি ঠেকায়। পানি দিতে চায় না আমাদের। না পারলে গেটগুলো খুলে দেয়। এবার তো বোঝাই গেছে, ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেবে। কারণ উজানে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কার উজানে বিশাল এলাকা, তিস্তার উজানে অল্প, একটি রাজ্য সিকিম। তো এই গেটগুলো খুলে দিলে হঠাৎ করে পানি বেড়ে যায়, তিস্তা এলাকার মানুষ এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। তিস্তা নিয়ে আমাদের যেহেতু সমঝোতা নেই, একটা বৈরী সম্পর্ক, এটা মানুষের মনে ভারতবিরোধী একটা মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। যে ওরা গেট খুলে দিলেই আমরা ভেসে যাব। এটা নিয়ে একটা প্রতিক্রিয়া আমরা এখানে দেখতে পেয়েছি যে ডম্বুর ড্যাম খুলে দেয়াতে এই বন্যা হয়েছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে ফেনী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম অন্তর্ভুক্ত, যেখানে পাঁচটি বড় নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, এফএফডব্লিউসি জানিয়েছে। [এএফপি]
আজকাল তো মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগ, ওখানের লোকজন ছবি তুলে দিয়েছে যে ডম্বুর ড্যাম খুলে দিয়েছে। খবর চলে এসেছে; কিন্তু ডম্বুর ড্যাম থেকে পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করতে লাগে ১০০ কিলোমিটার। এটা মেঘনা নদীর উজানে। এটা এসে কুমিল্লার ওদিক দিয়ে প্রবেশ করে। ডম্বুর ড্যাম গোমতী নদীর ওপরে। আর গোমতী নদীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা, কুড়ি শতাংশ এলাকা ভারতে। তাই ডম্বুর ড্যাম যতই ছাড়ুক না কেন, ওটা ভাটিতে খুব একটা প্রভাব ফেলে না; কিন্তু খবর যেহেতু রটে গেছে মানুষের মনে একটা আশঙ্কা, ভয় ঢুকে গেছে। গুজব তো অসংখ্য রটে; কিন্তু আসলে এটা সত্য না। সত্য হলো মুহুরী অববাহিকাতেই এত পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে যে, পানি এসে ফেনী জেলাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। ফেনীর সঙ্গে ডম্বুর ড্যাম বা গোমতী নদীর সম্পর্ক নেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: গত কয়েক দিন ধরে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে আবহাওয়াবিদরা বলছেন যে মেঘালয়ে ‘মেঘ বিস্ফোরণ’ হয়েছে। এর কারণেই কি এমন বৃষ্টিপাত হলো?
প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: এটাকে মেঘ বিস্ফোরণ না বলে মেঘ পতন বলা যেতে পারে। ইংরেজিতে বলে ক্লাউড বার্স্ট। মেঘপতন অনেকক্ষেত্রে হয়, স্থানীয়ভাবে, অল্প জায়গায়। একটা জায়গায় অনেক মেঘ জমে গেল, হঠাৎ করে পতন হলো। এই মেঘ পতনের একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, হরিদ্বারে হয়েছিল, না, ঋষিকেশে হয়েছিল। যেখানে হঠাৎ মেঘ পতনে কয়েক হাজার তীর্থযাত্রী ভেসে যায়; কিন্তু এটা একটি অল্প এলাকা। ক্লাউড বার্স্ট এত বড় এলাকা ধরে হয় না। ক্লাউড বাস্ট হলে অল্প এলাকা ধরে হতো; কিন্তু, এখানে যে বিশাল এলাকা ধরে বৃষ্টিপাত হয়েছে এটাকে ক্লাউড বার্স্ট বলা যায় না।
তিস্তা ব্যারেজ। [উইকিমিডিয়া]
ভিউজ বাংলাদেশ: নদীর অধিকার নিয়ে আমাদের কী করা উচিত?
প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: নদী অধিকার আমাদের ঐতিহাসিক দাবি। বুড়িগঙ্গায় লোকজন আর গোসল করতে নামতে পারে না। পানি কালো হয়ে গেছে। নদী ব্যবহারের অধিকার যেমন তিস্তাতে আছে, তেমনি বুড়িগঙ্গা পাড়ের মানুষেরও আছে। এটা তাদের ঐতিহাসিক অধিকার। যুগ যুগ ধরে, হাজার হাজার বছর ধরেই আছে। তুমি কে এই অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার! অনেকে নদীর হিস্যা শব্দটা ব্যবহার করে, এটা একটা ফালতু শব্দ। অনেকে না বুঝে ব্যবহার করে। আন্তর্জাতিক আইনে হিস্যা বলতে কিছু নাই। আছে, ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহার। দুই দেশের আইনে এই অধিকার নিয়ে এমনভাবে বলা আছে যে, উজান দেশের মানুষ যদি পানি এমনভাবে ব্যবহার করে, যাতে ভাটির দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা হতে দেয়া যাবে না।
এটা হলো আন্তর্জাতিক আইন। উজান দেশের ব্যবহারের কারণে যদি ভাটির দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাহলে আমি কেন হিস্যার কথা বলতে যাব? আমি বলব অধিকারের কথা। ন্যায্যতার কথা বলতে গিয়ে আমরা দাবি-দাওয়া আদায় করব। তিস্তাতে পানি নিয়ে যাচ্ছে, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। বছরে প্রায় ৫ হাজার টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। আমি বলেছি বারবার, আর কেউ বলে নাই। বলে নাই কারণ বেশির ভাগ মানুষ দাস মনোবৃত্তির, ভারতের কাছে নতজানু। এখন বড় বড় কথা বলছে। এতদিন কোথায় ছিল?
তবে, ১৯৭৭ সালে গঙ্গা পানিচুক্তির সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল। ভারত গ্যারাান্টি দিয়েছিল, পানি দেবই আমরা; কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এই পানি দেয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের একটা দপ্তর ছিল, আমিও সেই দপ্তরে কাজ করেছি, এই দপ্তরের কাজই ছিল কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা বের করা। পানি উন্নায়ন বোর্ডের কোনো না কোনো স্টোরে সেইসব ডকুমেন্টস এখনো থাকার কথা; কিন্তু, ১৯৯০-এর পর এ নিয়ে আর কথাবার্তা হয়নি; কিন্তু ওই যে ডকুমেন্ট ছিল, কেন? এটা এ জন্য যে ওদের জানানো, দেখো, আমাদের এই পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। একটা দরকষাকষি করা। ক্ষতিপূরণের কথা জানালেই আমরা ন্যায্যতার একটা সমাধান পেতে পারি। ক্ষতিপূরণের কথা না জানালে ওরা গুরুত্ব দিবে কী জন্য? ওদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় কোনো প্রত্যাশার ব্যাপার না, এটা আমাদের অধিকারের ব্যাপার। ওরা মাস্তানির জোরে পানি নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু আমাদের তো এ কথা বলতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে