Views Bangladesh Logo

জ্বালানি সংকট: স্বাবলম্বী হতে বাংলাদেশের লাগতে পারে ১৫ থেকে ২০ বছর

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প, আবাসিক, পরিবহনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রধান চালিকাশক্তি জ্বালানি। দেশের উন্নয়ন, জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে জ্বালানি চাহিদা; কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী জোগান, সরবরাহ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। প্রতিনিয়ত সংকটে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে জ্বালানি নিরাপত্তা। গেল শীত মৌসুমে জ্বালানির চাহিদা কম থাকলেও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। শিল্প ও আবাসিক খাতে ছিল তীব্র সংকট। জ্বালানি খাতের সংকট মোকাবিলায় হতে হচ্ছে আমদানিনির্ভর।

সংকট কাটিয়ে, চাহিদার ভিত্তিতে জোগান সামলে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে কবে নাগাদ স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব? বিশেষজ্ঞরা বলছেন সংকট গভীর। তবে দক্ষ উদ্যোগে সংকট কাটাতে লাগতে পারে ৩ থেকে ৫ বছর। আর স্বাবলম্বী হতে, ডলার সংকট মোকাবিলা, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব গ্যাস আহরণ, দেশীয় জ্বালানি সম্পদের ব্যবহার ও অনুসন্ধান, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার বাড়ানোর কথা বলছেন তারা। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে সেক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হতে লাগতে পারে ১৫ থেকে ২০ বছর সময়।

জ্বালানি ঘাটতি:
আমাদের জ্বালানির মূল সংকট প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাস, কয়লা, তেলে। যা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়; কিন্তু এর বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে তেলের প্রায় শতভাগই আমাদের আমদানি করতে হয় বাইরে থেকে। গ্যাসের দুটি অংশ এলএনজি ও প্রাকৃতিক গ্যাস তন্মধ্যে এলএনজি ও আমদানিনির্ভর।

বাংলাদেশের দেশের ৫৬% বিদ্যুৎ উৎপাদন গ্যাসনির্ভর। এ দেশের অন্যতম জ্বালানি উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। এ পর্যন্ত দেশের মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়মিত গ্যাস উত্তোলন চলছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট; কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তার মধ্যে আমদানি করা এলএনজি থেকে আসছে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে দৈনিক ঘাটতি তৈরি হচ্ছে ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার ২০২৪ সালের প্রতিবেদন বলছে, দেশের মোট গ্যাস মজুত ৩০.১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ); যার মধ্যে ১৯.৫ টিসিএফ এরই মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমান ব্যবহারের হারে আগামী ৯-১০ বছর এই মজুত চলবে। গ্যাস সংকট মোকাবিলায় নতুন অনুসন্ধান ও কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বহুমুখী সংকট:
বর্তমানে জ্বালানি সংকটের বহুমুখী কারণ দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার মধ্যে ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা, সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলন করা, শিল্পে পরিকল্পিত গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং অপচয় রোধ, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, কয়লা উত্তোলন এছাড়া দেশের অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখে সর্বোত্তম সাশ্রয় পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত জ্বালানি খাতে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের নিজস্ব গ্যাস সাশ্রয়ী হলেও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন আমদানিকৃত গ্যাস আনতে ডলারের খরচ অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। সেই চাপ আমরা সামলাতে পারছি না। এখান থেকেই মূলত বিদ্যুৎ সংকট আসছে। এছাড়া আমাদের গ্যাসভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্টের অধিকাংশ গ্যাসের অভাবে বন্ধ আছে। এছাড়া শিল্প খাতে গ্যাস ব্যবহার হয়। শিল্প খাতে রপ্তানি না হলে ডলার আসবে না। ডলার না আসলে গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকসহ বহুমুখী সংকট দেখা যাচ্ছে।



জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বাংলাদেশের চলমান জ্বালানি সংকট, সংকট উত্তরণ, গ্যাস অনুসন্ধান, জ্বালানিতে স্বাবলম্বী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে।

জ্বালানি সংকট আসলে কত গভীর?

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের মূল সংকট হলো প্রাথমিক জ্বালানি সংকট। সংকটটা গভীর। আমাদের বেশিরভাগ জ্বালানি আমদানিনির্ভর। অনেক দিনের সংকটের কারণে আমরা এখানে এসেছি সুতরাং হুট করে সমাধান হবে না। মূলকথা আমরা আমাদের গ্যাস আহরণ করার চেষ্টা বন্ধ করেছি। আমদানি কমাতে গেলে আমাদের নিজস্ব গ্যাস আহরণ বাড়াতে হবে। এছাড়া সাশ্রয়ী হতে হবে এলএনজি ব্যবহারে। দক্ষ জ্বালানি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে।

জ্বালানি সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সংযোজন করতে হবে। তাহলে ৩-৫ বছরে এ সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব। আমাদের যথেষ্ট ডলার থাকলে প্রশ্ন ছিল না কিনে আনতে পারতাম; কিন্তু এখন আমরা জ্বালানি খাতে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। এছাড়া গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস চুরি, অবৈধ সংযোগ, সিস্টেম লস না থাকলে ১০ ভাগ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতো।

জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে কি করণীয়?

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমদানিকৃত জ্বালানি দিয়ে আমরা কতখানি আগাতে পারব সেটা বিবেচনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মতো দেশের নিজস্ব জ্বালানির ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। যতটুকু আছে সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরবরাহ করার।

এছাড়া আমাদের অত্যন্ত ভালোমানের অনেক কয়লা আছে; কিন্তু পরিবেশবিদদের অবজেকশনের কারণে আমরা কয়লা তুলতে পারছি না। সেটা তুললেও আমাদের সংকট মোটামুটি কেটে যাবে। সেখানে ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ভালো থাকা সম্ভব।

নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ: আমরা যদি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎসহ সংশ্লিষ্ট জিনিস আনতে পারি তাহলে ভালো জায়গায় যেতে পারবো। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে অগ্রসর হতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি বছরে ১% বৃদ্ধি করে হলেও ২০ বছরে ২০% জ্বালানি কম আমদানি করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির সঙ্গে দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিলে জ্বালানি সংকট থেকে মুক্ত হতে পারবো।

জ্বালানিতে স্বাবলম্বী হতে বাংলাদেশের কত সময় লাগবে?

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা ঠিকভাবে কাজ করলে সংকট মোকাবিলা করতে ৫ বছর লাগবে। অনেকদিন ধরে যে সংকটে আছি সেখানে ৫ বছর কোনো ব্যাপার না। মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আসতে ৩ থেকে ৫ বছর সময় লাগবে। আর স্বাবলম্বী হতে হলে ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লেগে যেতে পারে। এর মধ্যে বড় কোনো গ্যাস ক্ষেত্র পেয়ে গেলে সময় কমে আসবে। এছাড়া কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলে সময় আরও কমে আসবে। এর সঙ্গে ডলার সিচুয়েশন ভালো হলেও সময় কমে আসবে। মিনিমাম ১৫ বছর লাগবে সব ঠিক হতে তবে পাঁচ বছর লাগবে ক্রাইসিস থেকে বের হয়ে আসতে। তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হবে; কিন্তু এখন সংকটটা গভীর।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ