রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়া আইএমএফের সব শর্ত পূরণ বাংলাদেশের
৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত ঋণ দিতে যে ১২টি শর্ত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), তার মধ্যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়া সবই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। ঋণের চতুর্থ কিস্তি সরবরাহের লক্ষ্যে সফর করে যাওয়া সংস্থাটির মিশন বলেছেন, বাংলাদেশ তাদের নির্ধারিত সব শর্তপূরণের পথে রয়েছে। তবে তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এটি নির্ধারিত সময়ে ঋণ পেতে বাধা হবে না।
বৈদেশিক রিজার্ভে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ২০২২ সালের শেষে আইএমএফের সহায়তা চেয়েছিল বাংলাদেশ। গত বছরের জানুয়ারিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর্থিক স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) প্রোগ্রামের অধীনে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে বহুপক্ষীয় ঋণদাতা সংস্থাটি।
এরই মধ্যে তিন ধাপে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তী ধাপের প্রায় ৬৮০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া উন্নত কর রাজস্ব সংগ্রহ, জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস এবং আর্থিক খাতে উন্নত শাসনসহ সংস্কার পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়নে নির্ভরশীল।
আইএমএফের শর্ত অনুসারে, বাংলাদেশ সরকারকে জুনের মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া ছিল। অর্থ বিভাগ দেখিয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা কম।
ক্রিস পাপাডাকিসের নেতৃত্বে আইএমএফ মিশনটি বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙ্গার লক্ষ্যে বহু বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনা করতে ৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা সফর করেছেন। ১৩ দিনের সফরে চতুর্থ ধাপে ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনে জন্য নির্ধারিত ১২টি শর্তপূরণ এবং আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রগতির মূল্যায়ন করেছেন তারা। মুদ্রাস্ফীতির চাপ, মুদ্রার অস্থিরতা এবং বহিরাগত ঋণ চ্যালেঞ্জের আলোকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা ছাড়াও পর্যালোচনা করেছেন বাস্তবায়িত কাঠামোগত সংস্কারও।
সফরটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হয়েছে, যখন বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে স্নাতক হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল দেশটি। সফরকালে সরকারি কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে এসব প্রচেষ্টারও পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝতে চান ক্রিস পাপাডাকিস। আলোচনা করেন বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কৌশল সম্পর্কেও।
আইএমএফ নির্ধারিত আরেকটি প্রধান শর্ত ছিল, দেশের নেট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ বাড়ানো, যা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অনুরোধে গত মে মাসে আইএমএফ প্রয়োজনীয় থ্রেশহোল্ড কমানোর পরে পূরণ হয়েছিল। ৩০ জুনের মধ্যে রিজার্ভের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। তবে, আইএমএফ এটিকে কমিয়ে ১৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন করার পর ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের নেট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
সফর শেষে বিবৃতিতে পাপাডাকিস বলেছেন, ‘এই চ্যালেঞ্জিং সময় মোকাবিলা এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির পথ নিশ্চিতে বাংলাদেশকে সহায়তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আইএমএফ। আমাদের সহযোগিতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ানো এবং দুর্বলতাগুলো মোকাবিলায় মনোনিবেশ করবে’।
এই মিশনের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও। জোর দিয়ে বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখা এবং বাহ্যিক বাধ্যবাধকতা মেটাতে আইএমএফ থেকে সময়মতো অর্থ বিতরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রিজার্ভ সাম্প্রতিক মাসগুলো চাপে রয়েছে। মুদ্রাব্যবস্থা স্থিতিশীল এবং আমদানি পরিচালনায় নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কাঠামোগত সংস্কারের শর্তগুলোর একটি হল, যুগোপযোগী মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রকাশ এবং বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেটি করা হবে।
ঢাকায় পাপাডাকিসের বৈঠকের ফলাফলগুলো ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণে সম্মত হয়েছেন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীরাও। কারণ, আ্ইএমএফের সংস্কার নির্দেশিকা মেনে চলতে সরকারের প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত দিয়েছে তারাও।
এই সফর বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং স্থিতিস্থাপকতা-নির্মাণের জটিলতাগুলো মোকাবিলায় গ্লোবাল সাউথের অর্থনীতিগুলোকে সমর্থনের ক্ষেত্রে আইএমএফের মুখ্য ভূমিকায়ও জোর দেয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে