নারী দল দেশের ফুটবলে বৈষম্যের শিকার হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা
সপ্তম নারী চ্যাম্পিয়নশিপে রুদ্ধশ্বাসপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফাইনালে বাংলাদেশ নারী দল স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে পরাজিত করে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে বাংলাদেশের প্রাধান্য আবারও ধরে রেখে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। দেশের নারী ফুটবলের মুকুটে আরেকটি উজ্জ্বল পলক সংযোজিত করতে সক্ষম হয়েছে। বিজয় উপহার দিয়ে দেশবাসীর প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করেছে। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যেয়ে নতুন সময়ে এই বিজয়-ফুটবলে নতুন ঝলমলে প্রভাত। নতুন ফুটবল ফেডারেশনের শুরুতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নারী জাতীয় দলের শিরোপা জয় শুভ সূচনা। নারী দলের সব খেলোয়াড়, কোচ, সাপোর্টিং স্টাফ এবং টিম ম্যানেজমেন্টের প্রতি আমাদের অভিনন্দন। আমরা সবার জন্য গর্বিত।
২০২২ সালে কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে নেপালকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে বাংলাদেশ প্রথম সাফ চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জিতেছিল। এরপর আবার ২০২৪ সালে ফাইনালে ২-১ গোলে নেপালকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জয়। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে পুরুষ জাতীয় দল যা পারেনি দেশের ফুটবলে উপেক্ষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার নারী দল সেটি করে সবাইকে জানান দিয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গি এবং মন মানসিকতার পরিবর্তনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেশের ফুটবলের আলো। নারী ফুটবলের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ফাইনালে বাংলাদেশের পক্ষে গোল করেছেন মনিকা চাকমা ও ঋতুপর্ন চাকমা। আর বিজেতা দলের তামিশা। খেলার ফাস্ট হাফ গোল শূন্য ছিল। টিম ম্যানেজমেন্টের একজন খেলার হাফ টাইমের সময় জানালেন, ‘খেলোয়াড়রা স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভর্তি দর্শকদের উন্মাদনার মধ্যেও স্নায়ুর চাপ সামাল দিয়ে খেলায় মনোসংযোগ ধরে রেখেছে, সমানতালে ৯০ মিনিট খেলতে পারলে হাসিমুখে মাঠ ছাড়বে এটি আশা করছি।’ শেষ পর্যন্ত নারী ফুটবলাররা আমাদের প্রত্যাশাকে সম্মান করেছেন।
নেপাল সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে সাতবারের মধ্যে ছয়বার ফাইনাল খেললেও এখন পর্যন্ত একবারও শিরোপা জয় করতে পারেনি। ভারত সবচেয়ে বেশি পাঁচবার শিরোপা জয় করেছে। বাংলাদেশ ২০১৬ সালে প্রথমবার ফাইনালে পৌঁছে রানার্স-আপ হয়েছে। এরপর ২০২২ ও ২০২৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৪-এ ফাইনালে সেরা এবং টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন ঋতুপর্ন চাকমা। ২০২২ সালে সেরা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।
সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ নারী দল খেলবে এটি সবাই জানেন। ২০২২ সালে প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবল আসর থেকে শিরোপা জিতেছে। নারী দল সমষ্টিগতভাবে সবাই বিশ্বাস করেছেন তাদের পক্ষে শিরোপা জয় অবশ্যই সম্ভব ২০২৪ সালে। তারা চেয়েছেন দেশবাসীকে আবার শিরোপা জয়ের আনন্দ উপহার দিতে। এরপরও আমাদের সমাজের সংশ্লিষ্ট মহলের কেউ কিন্তু এগিয়ে আসেনি এই টুর্নামেন্টটি নেপাল থেকে ‘লাইভ টেলিকাস্ট’ করার জন্য। যাতে দেশের মানুষ সবাই এক সঙ্গে খেলা উপভোগ করতে পারেন। এতে করে খেলোয়াড়রা বুঝতে পারতেন দেশবাসী তাদের পেছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে। কত অপ্রয়োজনীয় গুরুত্বহীন লাইভ টেলিকাস্ট তো আমরা দেখেছি ‘চাটুকারিতার’ প্রতিযোগিতায়। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতিযোগিতা চলছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অভিনন্দন জানানোর।
দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে বাংলাদেশ সেরা এটি আবার প্রমাণিত হয়েছে। কাঠমান্ডুতে মাঠে বিরামহীন লড়াই ছিল সম্মিলিত ফুটবলের পুরস্কার। নারী দল যেভাবে ৯০ মিনিট লড়েছে, দলগত সমঝোতা এবং বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে খেলা সাঙ্গ করেছে এটি অসাধারণ। বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের পরিকল্পনামাফিক এবং চিত্তাকর্ষক ফুটবল মাঠের উপস্থিত দর্শকদেরও দৃষ্টি কেড়েছে। নেপালের মিডিয়া উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ যোগ্য দল হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। খেলোয়াড়রা খেলেছে ভালো ‘ব্র্যান্ডের’ ফুটবল। খেলেছে ভালো ‘ব্র্যান্ডের’ ফুটবল। খেলেছে সাহসী ফুটবল। খেলোয়াড়দের স্ট্যামিনা এবং টেকনিক্যালি এগিয়ে ছিল। ফুটবলের ফাইটিং স্পিরিট ধরে রাখতে পেরেছে মাঠে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
অনেকেই অনেক কথা বলেন, তর্কে জড়িয়ে পড়েন তবে এটা তো ঠিক বিগত বাফুফের গভর্নিং বডি এবং নারী ফুটবল উইনার বছরের পর বছর ধরে নারী ফুটবলারদের ক্যাম্পে রেখে সারা বছর অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছে। এতে করে খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়ার জন্ম হয়েছে। স্কোয়ার্ডের সবাই একে অপরকে ভালোভাবে জানতে বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে কার সামর্থ্য এবং সম্ভাবনা কতটুকু আর এই যে সম্মিলিতভাবে নারী ফুটবলকে বাফুফের পৃষ্ঠপোষকতা এটির পুরস্কার হলো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারত ও নেপালের মতো শক্তিশালী দলকে পরাজিত করে শিরোপা জয়। ভারতের কথা বাদ দিলাম এক সময় তো নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশ নারী দল পেরে উঠেনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এখন তো তারা বাংলাদেশের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না। এই অগ্রগতি এবং সাফল্য তো অনেক বড় বিষয়। কোনো অবদানকে ইচ্ছা করলেই কী অস্বীকার করা যায়।
এবারের সাফ টুর্নামেন্টের ‘জার্নি’ ছিল বিতর্কিত। যেটি কাম্য ছিল না। কথা উঠেছে সিনিয়র জুনিয়র নিয়ে। কথা উঠেছে বিদেশি কোচ এবং প্রাক্তন কোচের ভূমিকা নিয়ে। কথা উঠেছে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে। সময়টা অস্থিরতায় ভরপুর তাই হয়তো আলোচনা বেশি। তবে স্বস্তির কথা একটাই মাঠের লড়াইয়ে এর প্রতিফলন হয়নি। আর তাই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আবারও মাথার ট্রফি খুলে দিচ্ছি নারী ফুটবলারদের উদ্দেশে যারা বছরের পর বছর ধরে পরিবার থেকে অনেক দূরে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও মানসিক শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে দেশকে গৌরান্বিত করেছেন।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে