Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বাংলাদেশ কোনোভাবেই সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না

Md Shakhawat  Hossain

মো সাখাওয়াত হোসেন

সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ন্ত্রাসবাদ একটি সামাজিক ব্যাধি। বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী দাভিদ এমিল দ্যুর্কেম বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ একটি সামাজিক ইস্যু এবং এটি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সন্ত্রাসবাদের কার্যক্রম প্রবেশ করেছে। সন্ত্রাসবাদ অন্যান্য সচরাচর অপরাধ থেকে ব্যতিক্রম, কেননা এর কার্যক্রম সাধারণত বেসামরিক জনগণকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসবাদের ঘটনাগুলোর অধিকাংশ বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্য করেই পরিচালিত হয়েছে। বেসামরিক জনগণকে নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল দেখানোর স্বার্থেই, আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের মনোবলে ঘাটতি আনার লক্ষ্যেই মূলত সন্ত্রাসবাদের ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাসীদের যে আনাগোনা দেখা যায়, তার পেছনে রাজনৈতিক শক্তির যোগসাজশ রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে যতসংখ্যক সন্ত্রাসবাদের ঘটনা ঘটেছে প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে থাকে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশব্যাপী হরতাল অবরোধের আহ্বানের পাশাপাশি বাস ট্রেনে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যার ঘটনা দেখেছে বাংলাদেশ, যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে তারা প্রত্যেকেই হরতাল অবরোধকে সমর্থনের মধ্য দিয়েই এসেছে। তাছাড়া যারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে, নির্বাচনে ভোট প্রদানে যারা সাধারণ মানুষকে হুমকি প্রদান করেছে, তাদের সমর্থনেই মূলত আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন একটি বড় আয়োজন, সে আয়োজনে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে দলীয়ভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি রাখতে হয়। কোনো একটি দল যদি আগুন সন্ত্রাসের দিকে নজর প্রদান করে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তাহলে ওই দলটি নির্বাচনে কীভাবে অংশগ্রহণ করবে? দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূলত এ ব্যাপারগুলোর বাস্তবায়ন হয়েছে।

তাছাড়া আগুন সন্ত্রাস যে দলই করুক না কেন সেই দল দিয়ে আর যাই হোক জনগণের সেবা নিশ্চিত করা যাবে না। অন্যদিকে দেখা যায়, যারা আগুন সন্ত্রাসের ওপর ভর করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে কাজ করছে। তাদের প্রত্যাশা হচ্ছে বিদেশিরা এ দেশের ওপর হস্তক্ষেপ করে সংবিধানের পবিত্রতাকে নষ্ট করে দিক, বিদেশিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশের সরকার গঠিত হোক। এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই, তারা কেবল বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়, সে জন্যই নির্বাচনের আগেই তারা বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিল। নির্বাচনের পরে তারা মনে করছে, বিদেশিরা তাদের এ দেশের শাসনভারের জন্য ন্যস্ত করবে। সে আশায় তারা এখনো রাজনীতির ছক আঁকছে। আদতে কি সন্ত্রাসীদের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে?

যারা সন্ত্রাসীদের মদদ প্রদান করে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে রাজনীতির পরিবর্তিত গতিপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কিংবা সন্ত্রাস নির্ভর রাজনীতির গোড়াপত্তন ঘটাতে চায়, তারা কিন্তু নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল নয়। তারা প্রকৃত অর্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বাসনায় রাজনীতি করছে না। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় আরোহণ করা এবং ক্ষমতার স্বাদ পেতে তারা সন্ত্রাসের রাস্তাকে বেছে নিয়েছে। যেখানে দেখা যায়, বিদেশি শক্তির অবৈধ হস্তক্ষেপ, দাগী আসামি, পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, পার্শ্ববর্তী দেশে লুকিয়ে থাকা চিহ্নিত সন্ত্রাসী, জামিনে বেরিয়ে আসা অপরাধী এদের সমন্বয়ে সাধারণ জনতাকে স্তব্ধ করে দিয়ে রাজনীতির মসনদে স্থায়ী আসন গড়তে চায়। তাদের রাজনীতির একমাত্র পথ হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা, যার কারণেই তারা নির্বাচনবিমুখ এবং নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে জ্বালাও পোড়াও এর মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের সূচনা করতে চায়। নির্বাচনের প্রাক্কালে আগুন সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডে সাধারণের মধ্যে বোধোদয় হয়েছে সন্ত্রাসীরা যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় চলে আসে, তাহলে দেশের মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, মানুষের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হবে; এক কথায় একটি অনিরাপদ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হবে। এ কারণে মূলত হরতাল অবরোধকে তোয়াক্কা না করে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটে অংশগ্রহণ করে নির্বাচনকে জমিয়ে তুলেছিল এবং সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যকে বাস্তবে প্রতিফলিত হতে ব্যর্থ করে দিয়েছে।

অন্যদিকে আগুন সন্ত্রাসীরা মনে করেছিল, তাদের হম্বিতম্বিতে সাধারণ মানুষ নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়বে। আমরা সবাই জানি নির্বাচনকালীন সময়ে একটি ট্রানজিশন পিরিয়ড পার করে এ দেশের জনগণ। এ সময়টাকে টার্গেট করে ৫ বছর ধরে দাগী আসামিরা বসে থাকে। নির্বাচনকালীন তারা মূলত মরণকামড় প্রদানের লক্ষ্যে সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে থাকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে সকল পর্যায়ের ষড়যন্ত্রকারীরা একত্রিত হয়ে এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে থাকে এবং তার নিমিত্তে তারা যে কোনো ধরনের কার্যক্রম হাতে গ্রহণ করে থাকে সন্ত্রাসীরা। আমরা দেখেছি এবং জেনেছি বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি, জনগণের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা নাই তথাপি তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে চায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে যারা সবসময় হুমকির মধ্যে দেখতে চায়; সব গ্রুপ নির্বাচনের প্রাক্কালে একত্রিত হয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। তাছাড়া বর্তমান সময়ে গুজবের রটনা, মিথ্যার বেসাতি দিয়ে গল্প সাজানো, মিথকে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে। সুতরাং এরা একটি গোষ্ঠী হয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, নির্বাচন ব্যতিরেকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় বসতে চায়। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এ দেশের ক্ষমতা দখল, জনগণের সেবা তাদের মুখ্য বিষয় নয়। কাজেই যারা জনগণকে বাইপাস করে ক্ষমতায় আসতে চায় তারা নির্বাচনমুখী হবে না এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা।

সন্ত্রাসীরা বারবার বাংলাদেশের মানুষের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছে, যদিও কিছুটা ক্ষেত্রে তারা বেসামরিক মানুষদের কষ্ট দিয়েছে তথাপি দীর্ঘমেয়াদে তারা সফল হতে পারেনি। বিশেষ করে যখন প্রমাণিত হয়েছে একটি গোষ্ঠী সন্ত্রাসীদের মদদ প্রদান করে বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে এ দেশের আপামর জনসাধারণ সবসময়ই সোচ্চার থেকেছে। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে সন্ত্রাসীদের দ্বারা এ দেশের কোনো মঙ্গল সাধিত হয়নি। সন্ত্রাসীরা উল্টো বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করেছে। সন্ত্রাসীদের কাছে দেশের মানুষের কোনো মূল্য নেই, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, যে কোনোভাবে এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে কলুষিত করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিলুপ্ত করে দেওয়া।

বাংলাদেশ আমার, আপনার, আমাদের সবার। এ দেশের কল্যাণের লক্ষ্যে, সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে আসুন ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে দেশের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে সামনের দিকে অগ্রসর হই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকল রাজনৈতিক দল জনগণের কল্যাণকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি স্মার্ট বাংলাদেশ বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। অপরাজনীতি, সন্ত্রাসের রাজনীতিকে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ বিচরণ করলেই দেশি বিদেশি অপশক্তি এটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে দেখা যায়, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। সে কারণেই বলা হয়, রাজনীতিবিদদের সন্ত্রাসীদের এড়িয়ে পথ চলতে হবে; বাংলাদেশ কোনোভাবেই সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। পরিশেষে বলা যায়, সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসীরা কখনোই নির্বাচনকে জনগণের হাতে ছেড়ে দিবে না। তাদের অভিপ্রায় তারা উল্টো পথে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ