কানে বাংলাদেশের অর্জন খুব একটা কম না
চলচ্চিত্র দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’-এর ৭৭তম আসরের পর্দা নামছে শনিবার (২৫ মে) রাতে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের শহর কানে প্রতি বছরের মে মাসে ১২ দিনের জন্য বসে এ আসর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালক, প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী অংশ নেন এ উৎসবে। গত কয়েক বছর ধরেই কানে নিয়মিত যাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইরিশ মডেল ও অভিনেত্রী মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি। অন্যান্য বছরের মতো এবারও সেখানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। এই ব্যস্ততার মাঝেই ফোনে কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের বার্তা সম্পাদক মারিয়া সালামের সঙ্গে।
মারিয়া সালাম: কান উৎসব সবসময়ের জন্যই আপনার কাছে একটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এবারের আসর ব্যক্তিগত কারণেই ভিন্নরকম। আপনি কী মনে করছেন?
প্রিয়তি: আপনি জানেন, কানের ৭৪তম আসরে ইন্টেগ্রিটি ম্যাগাজিন আয়োজিত টপ মডেল প্রতিযোগিতায় খেতাব জয় করেছিলাম; কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই কানে নিয়মিত আসছি আমি। মডেলিংয়ে বাইরেও আমি আইরিশ টেলিভিশন ও ফিল্ম একাডেমির একজন সদস্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নবীন-প্রবীণ অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলীদের আড্ডায় মুখর থাকে এ উৎসব। এটা নিজের পেশা বা আগ্রহের জায়গা থেকে যোগাযোগ স্থাপনের একটা দারুণ প্ল্যাটফর্ম। এ জন্যই কান উৎসব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, এবারের আসর ব্যক্তিগত কারণে আমার কাছে অনেক বিশেষ। আমি তৃতীয়বারের মতো মা হতে চলেছি এবং আমিই মনে হয় এবারের আসরের একমাত্র অন্তঃসত্ত্বা শিল্পী। বিষয়টি অনেকের কাছেই খুব চমকপ্রদ মনে হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এরকম আয়োজনে যোগ দেয়াটাকে অনেকেই একটি উদাহরণ হিসেবে দেখছেন, অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
মারিয়া সালাম: আপনি এখানে এসেছেন একজন আইরিশ মডেল ও অভিনেত্রী হিসেবে। তবে আপনি নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন বলে জানি। একজন বাংলাদেশি হিসেবে কানে নিজের মাতৃভূমির শিল্পীদের কেমনভাবে মূল্যায়ন করেন? বা অন্যরা তাদের কীভাবে দেখছেন বলে মনে করেন?
প্রিয়তি: প্রথমেই বলে রাখি, কান চলচিত্র উৎসব এমন একটি আয়োজন, যেখানে ব্যক্তি বা জাতির পরিচয়ে কাউকে বিচার করা হয় না। এটা একটি সর্বজনীন আসর। এখানে, সবাইকেই শিল্পী হিসেবে দেখা হয়। সেক্ষেত্রে, আইরিশ বা বাঙালি বলে আলাদা করে কেউ কাউকে বিচার করে না। হ্যাঁ, যারা এখানে বিজয়ী হবেন, তাদের অবশ্যই প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখা হবে। এ ছাড়া দেশ, জাতি বা ব্যক্তি হিসেবে আলাদা গুরুত্ব বা অবজ্ঞা পাবার কোনো ব্যাপার নেই। সেভাবে কেউ বিষয়টি দেখে না এখানে।
আর বাংলাদেশি বা বাঙালি হিসেবে আমি খুবই গর্বিত কারণ এ আসরে আমাদের প্রাপ্তি একেবারে কিন্তু কম না। কানের ৭৫তম আসরে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জুরি হিসেবে রেড কার্পেটে হেঁটেছেন চলচ্চিত্র সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরু। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচক আহমেদ মুজতবা জামাল ফিপ্রেসকি বিচারক ছিলেন ২০০২, ২০০৫ ও ২০০৯ সালে। এ বছর বাংলাদেশি চলচ্চিত্র সমালোচক ও চিত্রনাট্যকার সাদিয়া খালিদ রীতি ফিপ্রেসকি জুরি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। তিনি ২০১৯ সালেও এ দায়িত্ব পালন করেন।
আর সিনেমার হিসেবে বলতে গেলে, ১৯৫৮ নির্মিত খান আতাউর রহমানের উর্দু ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ কানে আমাদের গর্বিত করেছে। ২০১৬ সালে কান ক্ল্যাসিকস বিভাগে বাংলাদেশে চিত্রায়িত ছবিটি প্রদর্শিত হয়। এরপর, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ বাংলাদেশ থেকে কানে অংশ নিয়ে ফিপরেস্কিতে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায় ২০০২ সালে। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ২০২১ সালে জায়গা করে নেয় আঁ সার্ত্রে রিগা বিভাগে, যেটা ছিল কানের কোনো প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রথম কোনো সিনেমার জায়গা পাওয়ার ঘটনা। ২০২২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মে ভারতীয় প্যাভিলিয়নে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটির ট্রেলার প্রদর্শিত হয়। এসব আমাদের অর্জন।
মারিয়া সালাম: সিনেমার বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে ইদানীং অনেক বাংলাদেশি তারকা বা শিল্পী কানে আসছেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
প্রিয়তি: খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। কান এমন একটা আয়োজন, যেখানে আসতে হলে যে কেবল আপনাকে ফিল্ম নিয়েই আসতে হবে ব্যাপারটি এমন না। এটা বিশ্বজুড়ে সিনেমা ও শিল্পপ্রেমীদের একটা মিলনমেলা, যোগাযোগ স্থাপনের একটা প্ল্যাটফর্ম। আপনি এখানে যে কোনো গ্রুপ বা ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, নিজের চিন্তা-ভাবনা বিনিময় করতে পারেন আবার নিজের দেশের ব্র্যান্ড প্রোমোটর হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারেন। নিজের ভাষা, পোশাক, জীবনযাপনের রীতিনীতি এসব তুলে ধরতে পারেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। ফিল্ম ছাড়া বা এককভাবে কানে আসাটা খুব সহজ কথা না। ভিসা জটিলতা একটা বড় ব্যাপার। তারপর এখানে কিন্তু থাকাটা খুব ব্যয়বহুল। সে জায়গা থেকে যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে এসেছেন, তাদের আমি সাধুবাদ জানাব।
মারিয়া সালাম: আসর শেষ হয়ে এলো। আপনার এবারের অভিজ্ঞতা আর প্রাপ্তি কেমন ছিল?
প্রিয়তি: সে অর্থে, পুরা আয়োজনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ হয়তো আমি আবলোকন করতে পেরেছি। এখানে, প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার সিনেমা জমা পড়ে। সেখান থেকে ৫৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ও ১৪টা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা অফিশিয়াল সিলেকশনের জন্য নির্বাচন করে। কানের মূল আসরে মূলত এই ৭০টি সিনেমাই দেখানো হয়। সিনেমা প্রদর্শনের বাইরেও অনেক অনেক সাইড ইভেন্ট থাকে, আলোচনা থাকে, বিভিন্ন শো থাকে। এ সবকিছু একজনের পক্ষে উপভোগ করা প্রায় অসম্ভব। তবে যতটুকু দেখেছি, আমি মনে করি, আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। কানে এসেছি, এটাই একটা অনেক বড় প্রাপ্তি আমার জন্য। আমি একই সঙ্গে গর্বিত, আনন্দিত ও তুষ্ট।
একনজরে কান চলচ্চিত্র উৎসব
১. লেখক ফিলিপ্পে এরল্যাঙ্গার ১৯৩৮ সালে প্রথম ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজনের ধারণা দেন। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রথম আসর ১৯৩৯ সালে বা বসে, শুরু হয় ১৯৪৬ সালে।
২. ২০০২ সাল থেকে এটি কান চলচ্চিত্র উৎসব নামে পরিচিতি পায়।
৩. সেরা পুরস্কার ‘পাম দি’অর’ বা ‘স্বর্ণপাম’ প্রথম প্রদান করা হয় ১৯৫৫ সালে। ১৯৯৭ সালে পুরস্কারটিকে আধুনিকীকরণ করে এতে বসানো হয় ২৪ ক্যারেটের সোনা ও ক্রিস্টাল। এর বর্তমান মূল্য প্রায় ২৬ লাখ টাকা।
৪. এ পর্যন্ত ৫ হাজার সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে এবং ২০০ সিনেমা পাম দি’অর বা স্বর্ণপামের জন্য লড়াই করেছে।
৫. বিশ্বের ৮৯টি দেশ কানের প্রতিনিধিত্ব করে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে