ব্যাংক একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ, না কি অবলুপ্তি?
বাংলাদেশ সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন পেয়েছে। ইতিমধ্যেই অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশের অনুকূলে আইএমএফের ঋণ অনুমোদিত হবার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেভাবে ঋণ চেয়েছে আইএমএফ ঠিক সেভাবেই ঋণ মঞ্জুর করেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ আইএমএফ কোনো দেশকে বিনা শর্তে ঋণদান করে না। হয়তো দেশ ভেদে ঋণের শর্ত কিছুটা কঠোর অথবা নমনীয় হতে পারে মাত্র।
বাংলাদেশ এর আগে ১২-১৩ বছর আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। ফলে সংস্থাটি বাংলাদেশের ওপর কোনো শর্ত চাপিয়ে দিতে পারেনি। মাঝে মাঝে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিতো; কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সে সব পরামর্শ মেনে নিতে বাধ্য ছিল না; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীতি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে ঠিকই কিন্তু এ জন্য বেশ কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি শর্ত হচ্ছে আর্থিক খাত সংস্কারের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। বিশেষ করে আগামীতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই ব্যাংকিং খাতে নানা সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যবসায়রত থাকা ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ করা হবে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্বল ব্যাংকের আরও অনেক বেশি। কাজেই সেগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর আব্দুর রউফ তালুকদার দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ব্যক্তি খাতে ব্যবসায়রত ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠককালে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের জন্য কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা শুরুর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকটা হঠাৎ করেই ব্যক্তি খাতের সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংক পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড, যা এক সময় ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড নামে পরিচিত ছিল, তা এক্সিম ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে একীভূত হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একীভূতকরণের লক্ষ্যে ব্যাংক দুটি সম্প্রতি এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এই সমঝোতা স্মারকের অধীনে পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে। যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য কোনো নীতিমাল প্রণয়ন করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের আগেই পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড এবং এক্সিম ব্যাংক পরস্পর একীভূত হবার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। বিষয়টি কিছুটা হলেও গোলমেলে মনে হচ্ছে। এটা কি গাড়ির আগে ঘোড়া জুড়ে দেবার মতো হলো না?
ব্যাংক একীভূতকরণ নতুন কোনো বিষয় নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এক ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংক একীভূতকরণ হয়ে থাকে। কখনো বা একটি ব্যাংক অন্য ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে। পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড এবং এক্সিম ব্যাংক যেভাবে একীভূতকরণ করা হচ্ছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। এটা কি একীভূতকরণ নাকি অধিগ্রহণ? নাকি এক ব্যাংকের মাঝে অন্য ব্যাংক বিলীন হয়ে যাওয়া? ব্যাংক একীভূতকরণ একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। এ জন্য আগেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আমরা একীভূতকরণ বলতে কি বুঝবো আর অধিগ্রহণ বলতে কি বুঝবো- এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যায়িত থাকা প্রয়োজন। শাব্দিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে কোনটি একীভূতকরণ এবং কোনটি অধিগ্রহণ তা সজ্ঞায়িত হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। কোনো কারণে গণআস্থায় ছেদ পড়লে পুরো ব্যাংকিং কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হয়।
আগেই বলা হয়েছে, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত হওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে ব্যাংক একীভূত হবার ঘটনা খুব সচরাচর ঘটে না। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দুবার দৃশ্যমান ভাবে ব্যাংক একীভূতকরণ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি মালিকানাধীন ১০টি ব্যাংককে একীভূতকরণ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে ৪টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাংকগুলোর আগের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয়, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংক। সেই সময় এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশের সব ব্যাংকের নাম এবং মালিকানা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বিধায় ব্যাংকগুলোকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর দীর্ঘদিন দেশের কোনো ব্যাংক ও আর্থিক একীভূত করা হয়নি।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড গঠন করা হয়। ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। অনেকেই অজ্ঞতাবশত বলে থাকেন, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল বলে ব্যাংক দুটিকে রক্ষা করার জন্য একীভূতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিষয়টি মোটেও সে রকম নয়। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা লাভজনকভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত দুটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার খেলাপি ঋণের পরিমাণ সব সময়ই সিডিউল ব্যাংকের তুলনায় বেশি ছিল। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে খেলাপির হার এমনিতেই বেশি হয়।
সিডিউল ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ ঋণই স্বল্প মেয়াদি। ফলে সেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাধারণত কম হয়। কাজেই বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার খেলাপি ঋণের বিবেচনায় এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দ বিচার করা ঠিক হবে না। সেই সময় একটি উন্নয়ন সংস্থার থেকে বাংলাদেশের বেশ বড় আকারের ঋণ পাবার কথা ছিল। সেই ঋণ প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত ছিল বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূতকরণ করতে হবে। মূলত সে কারণেই বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করা হয়েছিল। এ ছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠানের কাজ মোটামুটি একই রকম। কাজেই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় একই রকম দুটি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন ছিল।
বিশ্বব্যাপী ব্যাংক একীভূতকরণ কোনো নতুন ঘটনা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ইত্যাদি দেশে মাঝে মাঝেই ব্যাংক একীভূতকরণ করা হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতে গত ৫১ বছরে মোট ৩৪টি ব্যাংক একীভূতকরণ করা হয়েছে। ভারতের বর্তমান ব্যাংকের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। বাংলাদেশ বর্তমানে ৬১টি ব্যাংক ব্যবসায়রত রয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে এত বিপুলসংখ্যক ব্যাংকের উপস্থিতির কারণে এই সেক্টরে নানা অনিয়ম এবং অনাচার সৃষ্টি হচ্ছে নিত্যদিন। ব্যাংকিং সেক্টরের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণের পর্বত প্রমান উপস্থিতি। খেলাপি ঋণের বোঝা ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসেছে; কিন্তু খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য কোনো পক্ষকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। রাজনৈতিক শক্তি, আর্থিক শক্তি এবং এক শ্রেণির অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের পরস্পর যোগসাজশে এই খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হচ্ছে। খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পর তা নিয়ে হা হুতাশ করে কোনো লাভ হবে না। বরং খেলাপি ঋণ যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সে লক্ষ্যে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্যাংক একীভূতকরণ করা হয় সাধারণত একাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক উন্নয়নের জন্য। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে দুবার একীভূতকরণের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন; কিন্তু একটি ক্ষেত্রে বড়ই মিল পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, যে ব্যাংকগুলো একীভূতকরণ করা হয়েছে, তাদের পূর্ব নাম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা নতুন নামে কার্যক্রম শুরু করেছে। যেমন, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের অবস্থা সব দিক থেকেই ভালো ছিল। কিন্তু একীভূত হবার পর তাদের কোনেটিরই পূর্ব নাম বহাল থাকেনি। কোনো প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তাকেও চাঁটাই করা হয়নি। কিন্তু পদ্মা ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক একীভূত হলেও তারা এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড নামেই কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অর্থাৎ পদ্মা ব্যাংকের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলেও এক্সিম ব্যাংকের অস্তিত্ব ঠিকই বহাল থাকছে। এটা কি একীভূতকরণ নাকি অধিগ্রহণ?
ব্যাংক সাধারণত দুভাবে একীভূতকরণ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় আলাপ-আলোচনার একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর সেটা যদি না করে, তাহলে তাদের একীভূতকরণের জন্য বাধ্য করা যেতে পারে। এক্সিম ব্যাংক এবং পদ্মা ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে অন্য ব্যাংকগুলো যে তা করবে, সেটা নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলপূর্বক একীভূতকরণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংককে তাদের সঙ্গে একীভূতকরণ করে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ঝুঁকি গ্রহণ করতে নাও চাইতে পারে। আবার কোনো দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে জোরপূর্বক একীভূত করা হলে সবল ব্যাংকটিও এক সময় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এতে ‘আম এবং ছালা’ উভয়ই চলে যাবার আশঙ্কা থাকবে। সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকজুড়ে দিলেই যে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বরং এতে বিপরীত চিত্র প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে।
দেশের অর্থনীতির সাইজ অনুসারে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। এটা যে কেউ স্বীকার করবেন। সর্বশেষ ব্যক্তি খাতে যে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হয়েছিল তখন বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্তি উত্থাপন করেছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু আপত্তি পাত্তা পায়নি। সেই সময় তৎকালিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, দেশের আর কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমোদন দান কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া উচিৎ নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন দিলে তার পরিণতি কি হয় আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি। দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূতকরণ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এটা ভাবার কোনো নেই। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।
একীভূতকরণ ‘সর্বরোগ সংহারক বটিকা’ নয় যে তা একবার গলদকরণ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একীভূতকরণের পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যক্তি মালিকানাধীন যেসব দুর্বল ব্যাংক আছে তাদের কর্তৃপক্ষকে একটি নির্দিষ্ট সময় (এক বছর বা দুই বছর) নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এই সময়ের মধ্যে যদি তারা পারফরম্যান্স ভালো করতে না পারে তাহলে তাদের অবলুপ্তি ঘটানো যেতে পারে। আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যেসব ব্যাংক আছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংককে বর্তমান অবস্থায় রেখে অবশিষ্ট ব্যাংকগুলোর শেয়ার বাজারে ছাড়ার ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো আবেগের স্থান নেই। এখানে বাস্তবতাকেই গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশ্বে দুধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ইউনিট ব্যাংকিং এবং অন্যটি ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং। ইউনিট ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকের সংখ্যা থাকে প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু শাখার সংখ্যা থাকে খুবই কম। মাত্র ১০/১২টি ব্রাঞ্চ নিয়ে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২/৩টি ব্র্যাঞ্চ নিয়েও একটি ব্যাংক স্থাপিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেম হচ্ছে ইউনিট ব্যাংকিং ব্যবস্থা। কিন্তু এই সিস্টেমে ব্যাংক দেউলিয়া হবার আশঙ্কা বেশি থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়শই ব্যাংক দেউলিয়া হবার খবর পাওয়া যায়। ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকের সংখ্যা থাকে কম। তারা বিপুল সংখ্যক শাখা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বৃটিশ ব্যাংকিং ব্যবস্থা হচ্ছে ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিংয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ব্রিটিশ উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশ ব্র্যাংক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু দেশে যেভাবে ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে তা ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিংয়ের উদাহরণ উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে না। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা পিউর ইউনিট ব্যাংকিং যেমন নয় তেমনি ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং ব্যবস্থার দৃষ্টান্তও নয়। এটা আসলে এক ধরনের মিশ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনুসরণ করবো। ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমস্যার মুখে আঘাত করতে হবে।
যে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হোক না কেনো রাজনৈতিক অঙ্গীকার (কমিটমেন্ট) ব্যতীত এই সেক্টরের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এটা বিবেচনায় রাখলেই ভালো হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে