সংকট কাটিয়ে গতি ফিরছে ব্যাংক খাতে
দেশের ব্যাংক খাতে এস আলম গ্রুপের লুটপাট, বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে যে স্থবিরতা চলছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। ‘আস্থা হারিয়ে’ যেসব গ্রাহক ব্যাংক ছেড়েছিলেন একদিকে তারা যেমন ফিরে আসছেন, অন্যদিকে বাড়ছে ডিজিটাল লেনদেন। ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে মুদ্রা বাজারেও। এতে স্থবিরতা কাটিয়ে স্বাভাবিক হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাতটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নানা কারণে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখছিল। টানা ১০ মাস গ্রাহকদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা গেছে। তবে সেই টাকা এখন ব্যাংকে ফিরে আনছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছরের নভেম্বর থেকে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখতে শুরু করে। এতে ব্যাংকগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তবে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এই প্রবণতা থেকে ফিরে এসেছেন গ্রাহকরা। এ সময়ে তাদের হাতে থাকা ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যাংকে ফিরেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, অক্টোবর শেষে ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখায় (যে বিভাগে টাকা জমা রাখা হয়) ছিল ৫১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। বাকি অর্থের ২১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা ব্যাংকগুলো ভল্টে এবং ২ লাখ ৭৯ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে। অক্টোবর শেষে প্রচলনে থাকা মোট টাকার পরিমাণ (হাতে ও ব্যাংকের ভল্টে একত্রে) ছিল ৩ লাখ ১ হাজার ৮১ কোটি টাকা।
যদিও গত আগস্ট শেষে ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের শাখায় ছিল ৩৫ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। বাকি অর্থের ২৩ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা ব্যাংকগুলো ভল্টে এবং ২ লাখ ৯৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা মানুষের হাতে ছিল। তবে ১৫ আগস্ট তা ছিল ৩ লাখ ১ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। আগস্ট শেষে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই মাসে মানুষের হাতে থাকা ১৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা ব্যাংকে ফিরেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেশ কিছু কারণে মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা বেড়েছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা, দুই ঈদের বাড়তি খরচ, ব্যাংক একীভূতকরণের খবর এবং জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের প্রভাবে অনেকে টাকা তুলে নিয়েছিলেন। তাই ব্যাংকের বাইরে টাকা বেড়েছিল। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা উদ্যোগে স্থিতিশীলতা ফেরায় ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। তাই ঘরে থাকা টাকা ব্যাংকে ফিরছে।
শুধু যে ঘরে থাকা টাকা ব্যাংকে ফিরছে তা নয়, একই সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল লেনদেনও। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কার্ডের মাধ্যমে মাসের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ‘নিরাপত্তার কারণে’ বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল এটিএম বুথ। ওই মাসে এটিএম কার্ড লেনদেনে ব্যাপক পতন দেখা দেয়। তবে তার পরের মাস সেপ্টেম্বরেই গতি পায় এটিএম, পয়েন্ট অব সেল (পস), কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (সিআরএম) ও ই-কমার্সে। যদিও এখনও বিভিন্ন ব্যাংকে প্রকট তারল্য সংকট রয়েছে। এতে দুর্বল ব্যাংকের এটিএম সেবা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এটিএম, পস, সিআরএম ও ই-কমার্সে ট্রানজেকশনে লেনদেন হয়েছে ৩৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, যা তার আগের মাস আগস্টে ছিল ৩৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে লেনদেন বেড়েছে ৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা বা ১২ শতাংশ। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বরে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৯ হাজার ৬৭০টি। তার আগের মাসে লেনদেন হয়েছিল ৩ কোটি ৯০ লাখ ১৫ হাজার ৫৬৫টি। লেনদেন বেড়েছে ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার ১০৫টি।
দেশজুড়ে এই মুহূর্তে এটিএম বুথ আছে ১৩ হাজার ১৬টি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বরে এটিএম বুথে লেনদেন হয়েছে ২ কোটি ৭১ লাখ ৮৮ হাজার ১৩টি, যা আগস্টে ছিল ১ কোটি ৭৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬৭৬টি। লেনদেন বেশি হয়েছে ২৭ লাখ ১৯ হাজার ১৩৭টি। সেপ্টেম্বরে লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা, আগস্টে যা ছিল ১৮ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। লেনদেন বেড়েছে ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে এটিএম বুথে লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন দোকান, বিপণিবিতানে পস মেশিনের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪৩০টি, লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ ২ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। তার আগের মাস মার্চে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ ৫২ হাজার ৮০০টি, লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ ২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ট্রানজেকশন বেশি হয়েছে ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৬৩০টি। লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩৮৫ কোটি টাকা।
গত সেপ্টেম্বর মাসে ই-কমার্সের মাধ্যমে ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯২১টি লেনদেন হয়েছে। একই সময়ে লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। তার আগের মাসে এই খাতে লেনদেন ছিল ৫৩ লাখ ১৬ হাজার ২২৯টি। লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২ হাজার ১ কোটি টাকা। সে হিসাবে লেনদেন বেড়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৫৯২টি। আর লেনদেনকৃত অর্থ বেড়েছে ১৬৭ কোটি টাকা।
গত সেপ্টেম্বরে সিআরএমে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫০৬টি। টাকার পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। তার আগের মাসে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪৬ হাজার ৭৬০টি। টাকার পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে ট্রানজেকশন বেড়েছে ২৬ লাখ ২৯ হাজার ৭৪৬টি। লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২ হাজার ৪৪ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও ভালো ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিট অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার কারণে গ্রাহকদের আস্থা কিছুটা ফিরেছে। এতে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে গতি বাড়ছে।
এদিকে দীর্ঘ সময় ধরে চলা অস্থিরতা কাটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারও বর্তমানে স্থিতিশীল রয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ডলার বাজার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ১৯ কোটি ডলার, গত অর্থবছরের একই মাসে ঘাটতি হয়েছিল ৩০ কোটি ডলার। ওই সময়ে ঘাটতি কমেছে ১১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে চলতি হিসাবে কোনো ঘাটতি হয়নি। বরং উদ্বৃত্ত হয়েছে ১১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ঘাটতি হয়েছিল ৬১ কোটি ডলার।
সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে চলতি হিসাবে আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। এর ফলে জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ঘাটতি হয়েছে ১৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয়েছিল ১৮৩ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঘাটতি কমেছে ১৭০ কোটি ডলার।
এ ঘাটতি কমার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা সাড়ে ৪ শতাংশ কমেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা বাড়েনি বরং কমেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা কমেছিল ১৭ শতাংশ। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহও কিছুটা বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এফডিআই বেড়েছিল ২৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ২৮ কোটি ডলারের বেশি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে