ব্যাংকে বাড়ছে খুদে শিক্ষার্থীদের আমানত
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকে স্কুল শিক্ষার্থীদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭১ কোটি টাকা। আগের মাস নভেম্বরে আমানতের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে খুদে শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং হিসাবে আমানত বেড়েছে ৩০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্কুল ব্যাংকিংবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে স্কুল ব্যাংকিংয়ে আমানতের স্থিতি ছিল দুই হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে আমানতের স্থিতি কমেছে প্রায় ১০৮ কোটি টাকা। তবে গত নভেম্বর মাসে এক বছরের ব্যবধানে ফারাক ছিল ১৫৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ফারাক কিছুটা কমেছে। এছাড়াও চলতি অর্থবছরের শুরুতে তথা জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা যা আগস্টে কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ১৭২ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে দুই হাজার ১৩৫ কোটি টাকা, অক্টোবরে কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে আমানত কমলেও ডিসেম্বর মাসে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক মাসে নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারগুলোর ওপর উচ্চ মূল্যস্ফীতির বড় প্রভাব পড়েছে। এতে দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোই অনেকক্ষেত্রে কঠিন হয়ে গেছে। ফলে স্কুল ব্যাংকিংয়ে আমানত রাখা অনেক অভিভাবকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এর সরাসরি প্রভাব দেখা গেছে ব্যাংক হিসাবে। জুলাই-আগস্ট মাসের আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে পুরো ব্যাংক খাত নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং আস্থাহীনতা তৈরি হয়। যার প্রভাব এড়াতে পারেনি স্কুল ব্যাংকিং হিসাবও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ক্রমাগতই বাড়ছে দেশের শিক্ষা ব্যয়। শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে ব্যয় বৃদ্ধির এই প্রভাবও পড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি কমার ‘ইঙ্গিতে’ সঞ্চয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে বাড়ছে আমানত।
ব্যাংকাররা বলছেন, সাধারণত যে কোনো শ্রেণির হিসাবে আমানত অল্প হলেও বাড়তে থাকে। কারণ কেউ যদি নতুন করে টাকা জমা নাও দেয় তবুও আগের জমা করা আমানতের সুদ যোগ হয়ে মোট অঙ্ক বাড়তে থাকে। আর যদি গ্রাহকরা তার মুনাফার টাকা উত্তোলন করে ফেলেন তাহলে হিসাব অপরিবর্তিত থাকে। তা ছাড়া নতুন বাড়তে থাকা হিসাবের আমানত যোগ হয়। গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো নতুন করে যেসব হিসাব খোলা হয়েছে কিংবা আগের হিসাবে যে পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে তার চেয়ে বেশি অঙ্কের টাকা উত্তোলন হচ্ছিল। অর্থাৎ আর্থিক চাপের কারণে শিক্ষার্থীরাও তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। তবে ডিসেম্বরে কিছু নতুন হিসাব খোলা হয়েছে এবং যুক্ত হয়েছে কিছু নতুন আমানত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের গত ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকে শিক্ষার্থীদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩ লাখ ৮০ হাজার ১৫৯টি। আর তার আগের মাস নভেম্বরে হিসাব সংখ্যা ছিল ৪৩ লাখ ৪২ হাজার ২৫৯টি। সে হিসেবে এক মাসে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৩৭ হাজার ৯০০টি। গত নভেম্বরেও আগের মাসের তুলনায় ২২ হাজার হিসাব কমেছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ ছেলেদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২টি আর মেয়েদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৮৭টি। তার আগের মাস নভেম্বরে ছেলেদের হিসাব সংখ্যা ছিল ২২ লাখ ৫ হাজার ৯৮৪টি আর মেয়েদের হিসাব সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৫টি। সে হিসেবে ডিসেম্বরে ছেলেদের হিসাব বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৮৮টি ও মেয়েদের হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ১১ হাজার ২১২টি।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সাধারণত বছরের শুরুতে কিংবা শেষের দিকে অনেকের টাকা উত্তোলনের চাপ থাকে। অনেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় বেড়াতে যান। আবার অনেকে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতে গিয়ে আমানত ভাঙেন; কিন্তু বছরের পুরো সময়জুড়ে শিক্ষার্থীদের আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে নিয়মিত খরচ মেটাতে হিমশিম অবস্থার মধ্যেই আমানত উত্তোলন করতে হচ্ছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি এমনটাই ইঙ্গিত করছে। এত কিছুর পরও ডিসেম্বরে যে উন্নতি হয়েছে তা বড় ইতিবাচক।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আমাদের ব্যাংক খাতের ওপর একধরনের আস্থাহীনতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যদিও সেটা ধীরে ধীরে কেটে উঠছে। এর একটা প্রভাব স্কুল ব্যাংকিংয়েও পড়েছিল। এখন ব্যাংকগুলোকে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা ও তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। এই কার্যক্রমের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে টাকা জমানোর অভ্যাস তৈরি করা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তাদের আরও উপযোগী করে তোলা।
২০১০ সালে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বছরে ২৯ হাজার ৮০টি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয়। এর পরের বছর ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় ব্যাংকগুলোতে এক লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি হিসাব খোলা হয়। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাব ও আমানতের পরিমাণ কিছুটা কমে আসছে। এরপর থেকেই স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় মুনাফার নানা স্কিম চালু করে।
এ পর্যন্ত ৫৯টি ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করেছে। ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এই অ্যাকাউন্টগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন- সব ধরনের ফিস ও চার্জের ক্ষেত্রে রেয়াত পাওয়া, বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়া, ন্যূনতম স্থিতির বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে ছাড় ও স্বল্প খরচে ডেবিট কার্ড পাওয়ার সুযোগ। মাত্র ১০০ টাকা আমানত রেখেই এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে