বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তা ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত প্রাচীন রাজতন্ত্রকে মনে করিয়ে দেয়
বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবক সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকাড়ি আরোপ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাংবাদিকরা ব্যাংকের নির্দিষ্ট অনুমতিপত্র (প্রবেশ পাস) নিয়ে শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। তবে কোনো কর্মকর্তা যদি সাংবাদিকদের পাস দেন, সেক্ষেত্রে তারা শুধু সেই কর্মকর্তার কাছে যেতে পারবেন। আগের মতো তারা অবাধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো বিভাগে প্রবেশ করতে পারবেন না।
যখন রাষ্ট্র, সরকার, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি বিশ্বজুড়ে সামনে চলে এসেছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে সবাইকে বিস্মিত করেছে। তবে কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তা ব্যক্তিরা পেছনে হাঁটতে চায়? সব কিছু ঢেকে রাখতে চায়? তা না হলে কেন এই স্বেচ্ছাচারিতামূলক গোপনীয়তা আরোপের সিদ্ধান্ত?
জনস্বার্থে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের তথ্য প্রকাশের অবারিত সুযোগ থাকা দরকার। যাতে আর্থিক খাতের সব ধরনের অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার বিষয়গুলো সামনে আসে, যেখান থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের সঠিক নীতি ও কৌশল গ্রহণের সুযোগ পায়। সেটা বন্ধ করে দেবার কারণ কি? এটা কি কেবলই সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা থেকে দূরে থাকার প্রয়াস? না কি বড় কোনো কেলেঙ্কারিকে ঢেকে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা?
আমরা জানি দেশের ব্যাংকিং খাত অনেকদিন ধরেই নানা সংকটে নিপতিত। খেলাপি ঋণ, আর্থিক প্রতারণা ও জালিয়াতি এবং সার্বিক সুশাসনের অভাবে অনেকদিন ধরেই ধুকছে। এমন সময়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহ বন্ধের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কী বার্তা দিতে চান? তবে কি খাদের কিনারায় উপনীত ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিজেদের ব্যর্থতার তথ্য গোপন করতেই এই উদ্যোগ? নাকি যারা ঋণখেলাপি, জালিয়াতিসহ এ খাতের সংকটের জন্য দায়ী, তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এ বিধিনিষেধ?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, নানা সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের গণমাধ্যম এখনো আর্থিক দুর্নীতির খবরগুলো প্রাদপ্রদীপের আলোয় আনার চেষ্টা করছে। গত কয়েক বছরে আর্থিক খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারির তথ্যগুলোর বেশির ভাগই সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশাধিকারের সূত্র ধরে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কি তাহলে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের মতো অপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে পাসনির্ভর ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হচ্ছে, প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, সেটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে মোটেও সহায়ক নয়। সাংবাদিককে অনেক সময় গোয়েন্দার মতো কাজ করতে হয়। আর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাই আর সাংবাদিকদের ছায়া মাড়াতে চাইবেন না। কারণ ব্যাংকিং খাত নিয়ে কোনো সাংবাদিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সবার আগে খোঁজ পড়বে, তাকে কে প্রবেশের অনুমতি দিল। কোন কর্মকর্তা তার সঙ্গে কথা বলল। তখন ওই কর্মকর্তার জীবনে গজব নেমে আসবে। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মুখে শৃঙ্খল এঁটে দেওয়া হবে।
এতে তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ কার্যত রুদ্ধ হবে। ব্যাংক খাতে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কারা জনগণের অর্থ লোপাটের ফলে লাভবান হচ্ছেন, তা জানার অধিকার থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করা হবে।
এমনিতেই আমাদের দেশে নানাভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়। যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে, তারা সবার আগে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করে। নিরপেক্ষ গণমাধ্যম সব সময়ই ক্ষমতাবানদের চোখের বালি। বিশেষত, সেই ক্ষমতাবানদের- যারা নাগরিক স্বাধীনতা অর্থাৎ গণতান্ত্রিকতার তোয়াক্কা করেন না। ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়’- জনসমক্ষে এ কথাটি বারংবার জিজ্ঞাসা করে চলাই নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের কাজ। প্রশ্নটি দমনপ্রিয় ‘রাজা’র পক্ষে অস্বস্তিকর, ফলে যে গণমাধ্যম দাঁড়ের টিয়াপাখি হতে অসম্মত হয়, তার কণ্ঠরোধ করার তাড়না প্রকট হয়ে ওঠে।
ক্ষমতাবানদের সুরে সুর না মেলালে সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের কী হয়, কী হতে পারে, তার উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে ভুরি ভুরি। প্রতিনিয়ত তা নানাভাবে প্রকাশ পায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গের নিচে এখন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের জীবন। একটু এদিক-ওদিক হলেই পুলিশের ধরপাকড়, অথবা বিশেষ তদন্তকারী সংস্থার অভিযান। রয়েছে মানহানি বা অন্য কোনো মামলা রুজু করা, যার বিরুদ্ধে মামলা, তিনি বছরভর এক আদালত থেকে অন্য আদালতে দৌড়ে বেড়াতে বাধ্য হন। বহু ক্ষেত্রেই সেই মামলা শেষ অবধি খারিজ হয়ে যায়, অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পান; কিন্তু মামলার প্রক্রিয়াটিই যথেষ্ট শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়- বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে শাস্তি।
গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ নেই, তা নয়। এখানে মনগড়া খবর প্রকাশ করা হয়, বিকৃত তথ্য বা অর্ধসত্য প্রকাশ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুল বা মিথ্যে খবরও ছাপা হয়। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, গণমাধ্যম নিজস্ব বিচারসভা বসায়- যাকে বলা হয়ে থাকে ‘ট্রায়াল বাই মিডিয়া’। গণমাধ্যম কখনো তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে না, তেমন দাবি করা অনুচিত হবে; কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য যে, যারা মিডিয়ায় বিচারসভা বসাতে অভ্যস্ত, ক্ষমতাবানরা বহু ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হন না- কারণ, তারা ক্ষমতাবানদের পক্ষেই তারস্বরে চিৎকার করেন। মিডিয়ার বিচারসভা যে পক্ষেই রায় দিক না কেন, তাকে যে গণতান্ত্রিক সীমার মধ্যেই রাখতে হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই; কিন্তু গণমাধ্যম কী বলবে, কতটুকু বলবে, কার সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ হতে পারে না। মনে রাখতে হবে নাগরিকের কাছে তথ্য এবং মতামত পৌঁছে দেওয়ার কাজটি গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের পক্ষে অপরিহার্য। গণমাধ্যম যাতে সেই কাজটি করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তটি দ্রুত প্রত্যাহার জরুরি।
সমাজকে সুস্থ, সবল করতে হলে গণতন্ত্রের শক্তিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। তার জন্য সংবাদপত্রকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তা ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত প্রাচীন রাজতন্ত্রকে মনে করিয়ে দেয়। সত্যের মুখোমুখি তারা এরা ভয় পায়, তাই সত্য প্রকাশের চেষ্টা করলেই গলা টিপে ধরতে যায়।
প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক বেন ব্র্যাডলি বলেছিলেন, ‘ওদের ক্ষমতায় লাগাম পরানোর কাজটা তো আমাদের।’ আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্রে নিজেদের ভূমিকা যথাযথ পালনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমকে। গণমাধ্যমের কাজ ক্ষমতাবান, শাসক ও প্রতিষ্ঠানে গুণগান করা আর দোষত্রুটি ঢেকে চলা নয়। বরং, দোষগুলো যথাযথ প্রচারের আলোতে আনা চাই, যাতে গণতন্ত্র সঠিক পথে চলে। গণতন্ত্রে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম, সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশাও অনেক।
ধৃত রাষ্ট্রের মুখ দিয়ে বলদর্পী দুর্যোধনের প্রতি রবীন্দ্রনাথ বলিয়েছিলেন, ‘নিন্দাকে রসনা হতে নির্বাসন দিলে তা গোপন হৃদয়দুর্গে শক্তিবৃদ্ধি করে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করে ব্যাংকের অনিয়ম-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করার বাসনাও তদ্রূপ। সামনে থেকে যা সরে যায়, তা পেছনে আরও শক্তিবৃদ্ধি করিতে বাধ্য। গণমাধ্যমে ইতিবাচক-নেতিবাচক সব খবর প্রকাশ হওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। মুখ বন্ধ করে রাখতে চাইলে বরং নেতিবাচক জিনিসগুলো দ্রুত ছড়ায়। তা গুজব আকারে ছড়ায়, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ায়। সংবাদ অপেক্ষা গুজব দ্রুত ছড়ায়। প্রকৃত তথ্যের অভাবে তাকেই মানুষ ‘খবর’ বলে বিশ্বাস করে। বিশেষত উচ্চ-প্রযুক্তির এই যুগে যে জনসংযোগ বন্ধ করা অসম্ভব, তা প্রমাণিত।
গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এই অনাস্থার কারণ কী? গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে বিরোধিতার ওপর নিয়ন্ত্রণ করবার প্রচেষ্টা কম দেশে হয়নি। তাতে লাভ হয়েছে কি? আপাত-সুবিধাটুকু ক্রমেই আরো বেশি ঝুঁকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
পরিশেষে উল্লেখ করছি রবীন্দ্রনাথের ‘কণ্ঠরোধ’ নিবন্ধের কয়েকটি লাইন, যা তিনি ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে বসে লিখেছিলেন। আজ আবার কেন তাকেই স্মরণ করতে হচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় যাওয়া নিষ্প্রয়োজন।
‘যদি রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটিয়া থাকে তবে তাড়াতাড়ি ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া ভয়কে আরও পরিব্যাপ্ত করিয়া তুলিতেছ কেন। যে একমাত্র উপায়ে আমরা আত্মপ্রকাশ করিতে পারি, তোমাদের নিকট আপনাদের পরিচিত করিতে পারি, তাহা রোধ করিয়া ফল কী।
সিপাহি বিদ্রোহের পূর্বে হাতে হাতে যে রুটি বিলি হইয়াছিল তাহাতে একটি অক্ষরও লেখা ছিল না- সেই নির্বাক নিরক্ষর সংবাদপত্রই কি যথার্থ ভয়ংকর নহে।... সংবাদপত্র যতই অধিক এবং অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম-অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না। যদি কখনো কোনো ঘনান্ধকার অমাবস্যারাত্রে আমাদের অবলা মাতৃভূমি দুরাশার দুঃসাহসে উন্মাদিনী হইয়া বিপ্লবাভিসারে যাত্রা করে তবে সিংহদ্বারে কুকুর না ডাকিতেও পারে, রাজার প্রহরী না জাগিতেও পারে, পুররক্ষক কোতোয়াল তাকে না চিনিতেও পারে; কিন্তু তাহার নিজেরই সর্বাঙ্গের কঙ্কণ কিঙ্কিণি নূপুর কেয়ুর, তাহার বিচিত্র ভাষার বিচিত্র সংবাদপত্রগুলো কিছু-না-কিছু বাজিয়া উঠিবেই, নিষেধ মানিবে না।’
লেখক: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে