রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তৎপর হোন
ইতিহাসের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শরণার্থীর ভার নিয়ে এবারের শরণার্থী দিবস পালন করা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বর্তমান পৃথিবীতে ১০ কোটি ১০ লাখের ওপর মানুষ স্বদেশ থেকে উদ্বাস্তু। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, আঞ্চলিক অস্থিরতার সঙ্গে মানুষকে দলবদ্ধভাবে ভিটেমাটি ছাড়া করছে পরিবেশ বিপর্যয়। বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের অমানবিক অবস্থানের প্রতি আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ২০০১ সালে থেকে জুন মাসের ২০ তারিখ আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
দেশহীন, বাস্তুহারা, বিতাড়িত, মাতৃভূমিচ্যূত শরণার্থীদের রক্ষা করা, তাদের অবস্থাকে সমর্থন জোগানো এবং নিজ দেশে ফেরা বা যথোপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘ বা কোনো দেশের সরকারের অনুরোধে কাজ করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা, ইউএনএইচসিআর; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, শরণার্থীদের ঘরে ফেরাতে ব্যর্থ হচ্ছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের মোড়ল দেশগুলো। শরণার্থী সংকটের মৌলিক সমাধানের পরিবর্তে তারা বরং নামমাত্র কিছু তহবিল জুগিয়ে মানবিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে চায়। সেই তহবিলও এখন উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসছে। ২০২৩ সালে এই তহবিল ঘাটতি ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। প্রায় ৭ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রিত। রোহিঙ্গা সংকটে চাহিদার তুলনায় ২০২৩ সালে জোগার হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ তহবিল। ফলে রোহিঙ্গা ত্রাণ কর্মসূচির বাইরেও বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। বাংলাদেশ যখন এই ব্যয় জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে তখন বিশ্বব্যাংক ঋণপ্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন এমনিতেই ঋণের ভারে জর্জরিত। মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৫৮০ ডলার। এখন মানবিক প্রয়োজনে ঋণ নিতে গেল বাংলাদেশ আরও সমস্যায় পড়বে।
এমতাবস্থায় প্রত্যাবাসনই একমাত্র উপায়। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই ঋণ রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ৮ জুন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা সংকটে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণ না করার জন্য ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ৯টি নাগরিক ও উন্নয়ন সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছে। ইক্যুইটি অ্যান্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইক্যুইটিবিডি) আয়োজিত সমাবেশে বক্তরা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার যখন সহায়তা চেয়েছে, তখন বিশ্বব্যাংক বলেছে এর জন্য বাংলাদেশকে ঋণ নিতে হবে।
আমরা এর প্রতিবাদ করছি, কারণ, এই সংকটের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়, যে তাকে ঋণ নিতে হবে। অন্য দিকে, মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়ে যেসব রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বরাবরই আপত্তি জানিয়ে আসছে সরকার। শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন যে, রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য এবং তাদের সেটি দেয়া উচিত। কারণ আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুসারে তো বটেই, রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ ঘোষণা না করে বরং অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতির মুখে পড়ছে সরকার।
আবার অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করে বলছেন যে, রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর সুবিধার জন্য এটি বাংলাদেশের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। ১৯৯২ সালের আগে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তাদের শরণার্থী হিসেবে হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই সময়ে প্রায় ৩২ হাজারের মতো শরণার্থী বাংলাদেশে থেকে যায়। তবে ১৯৯২ সালের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে এসেছে তাদের আর শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তাদেরকে বলা হচ্ছে, ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক।’
এখন এই রোহিঙ্গা ‘শরণার্থী’ বা ‘বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’দের যদি কোনোভাবেই দেশে ফেরানো না যায়, তা বাংলাদেশের জন্য প্রধান একটি জাতীয় সংকটে রূপ নেবে। দেশের অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলার ওপর তা ইতোমধ্যেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে বলাই বাহুল্য। তাই আর দেরি না করে বাংলাদেশ সরকারকে এখনই রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত নিরসনে তৎপর হতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে