বিহেভিয়ারাল ইকোনমির এপিঠ-ওপিঠ
কয়েক বছর আগে রিচার্ড থ্যালার যখন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেন, তখন অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। কারণ রিচার্ড থ্যালার যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর একটি সাবজেক্ট। তিনি অর্থনীতির স্বল্পালোচিত একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয়টি ছিল বিহেভিয়ারাল ইকোনমি বা আচরণগত অর্থনীতি। বাজারে একটি পণ্যের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি ভোক্তার আচরণের ওপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার এবং তার ক্রয় চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাই ছিল তার গবেষণার বিষয়। রিচার্ড থ্যালার বিহেভিয়ারাল ইকোনমি নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার অর্জন করার পর অর্থনীতিবিদরা নড়েচড়ে বসে। আগে যারা এ বিষয়ে কোনো মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি তারাও নতুন করে ভাবতে শুরু করে। তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের মাঝেও ইস্যুটি নতুন ভাবনার জন্ম দেয়।
বিহেভিয়ারাল ইকোনমিস্টরা প্রধানত বাজারে পণ্যমূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে ভোক্তার আচরণের ওপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে, সে বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করেন। বাজারে কোনো বিশেষ পণ্যের মূল্য হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেলে ভোক্তা সমজাতীয় বিকল্প পণ্য অনুসন্ধান করে। তিনি এমন পণ্য পেতে চান, যা তার বাজেটের মধ্যে ক্রয় করা সম্ভব। অথবা তিনি একই পণ্য আগের তুলনায় পরিমাণে কম ক্রয় করে তার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন। অথবা তার চাহিদা সংকোচনে ব্রতী হন। পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাজারমূল্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভোক্তার স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, সে একই মানের পণ্য সব সময়ই তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে চান। বাজারে পাশাপাশি দুটি দোকানে একই ব্র্যান্ডের সমজাতীয় পণ্য থাকলে যে দোকানে কম মূল্যে পণ্যটি পাওয়া যাবে, ভোক্তা নিশ্চিতভাবেই সেখান থেকেই পণ্যটি ক্রয় করতে চাইবেন। এটাই ভোক্তার সাধারণ প্রবণতা। এর ব্যত্যয় ঘটে না বললেই চলে। ভোক্তা সমাজের যে স্তর থেকেই আসুন না কেন, তিনি তুলনামূলক সস্তা পণ্যটিই পেতে চাইবেন। পণ্যমূল্য একজন ভোক্তার মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে কীভাবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে বিহেভিয়ারাল ইকোনমি, তা নিয়েই কাজ করে।
এখানে কনজুমার্স সারপ্লাস থিউরির ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। কনজুমার্স সারপ্লাস থিউরির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে এমন- কোনো একজন ভোক্তা বাজারে গিয়ে একটি পণ্য বা সেবা ক্রয় করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। এই প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য তাকে অর্থ ব্যয়ের জন্য কস্ট ভোগ করতে হয়। বাজারে গিয়ে তিনি যদি কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি যে অর্থ ব্যয় করে তিনি ক্রয় করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন, তার চেয়ে কম অর্থ ব্যয় করে ক্রয় করতে পারেন, তাহলে তিনি যে মানসিক তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি অর্জন করবেন, সেটাই ভোক্তার উদ্বৃত্ত। মনে করি, কোনো ব্যক্তি এক ডজন বা ১২টি ডিম ১৫০ টাকা দিয়ে ক্রয় করার জন্য মানসিক এবং আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে বাজারে গেলেন; কিন্তু তিনি বাজারে গিয়ে দেখলেন, ডিমের ডজন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তাহলে তিনি এক ধরনের মানসিক স্বস্তি লাভ করবেন। এই স্বস্তি হচ্ছে প্রত্যাশার চেয়ে কম অর্থ ব্যয় করার স্বস্তি। অবশ্য বর্তমানে বাজারে যে অবস্থা, তাতে ভোক্তার উদ্বৃত্ত লাভের সুযোগ তেমন একটা পাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং প্রতিনিয়তই ভোক্তাদের কনজুমার্স ডেফিসিটে ভুগতে হয়। যে মূল্যে পণ্য ক্রয় করবেন বলে বাজারে যান, তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়। বাজারে গিয়ে প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কোনো পণ্য ক্রয় করতে হলে ভোক্তার মনে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তার মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে। তার আচরণে এই খারাপ মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। বাজারে গিয়ে একজন ভোক্তা তার প্রত্যাশিত বাজেটের কম মূল্যে যদি একটি পণ্য ক্রয় করতে পারেন, তাহলে তার মাঝে পণ্যটি বেশি পরিমাণে ক্রয়ের প্রবণতা জাগতে পারে। তাই বলা হয়, কনজুমার্স সারপ্লাস ভোক্তাকে মানসিক স্বস্তি দেয়। তিনি এক ধরনের মানসিক তৃপ্তি এবং উদ্দীপনা লাভ করেন। এই উদ্দীপনা তাকে বর্ণিত পণ্যটি বেশি পরিমাণে ক্রয়ে উৎসাহিত করতে পারে।
অনেকেই কথায় কথায় বলেন, ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল।’ কিন্তু এই প্রবাদ বাক্যটি মোটেও ঠিক নয়। কারণ অর্থ ছাড়া দুনিয়া অচল, যার যত বেশি অর্থ আছে তার আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন। অর্থ ছাড়া আমাদের এক দিনও চলে না। পৃথিবীতে অর্থের মতো শক্তিশালি আর কিছু নেই। অর্থ আয় করা যত কঠিন, পরিকল্পিতভাবে সঠিকভাবে অর্থ ব্যয় করা আরও বেশি কঠিন। অর্থ ব্যয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা। কেউ কেউ অর্থ ব্যয় করে আরও বেশি অর্থ অর্জন করার রাস্তা খুঁজে বের করে; কিন্তু কাজটি খুব একটা সহজ নয়। অনেকেই অর্থ ব্যয় বা বিনিয়োগ করে আরও বেশি অর্থ অর্জন করতে গিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন, এমন উদাহরণ অনেক দেয়া যায়।
অর্থ ব্যয় করলে উদ্যোক্তা হওয়া যায়; কিন্তু সবাই উদ্যোক্তা হতে পারেন না। উদ্যোক্তা হতে হলে কিছু গুণাবলি থাকতে হয়, যা সবার মাঝে জন্মগতভাবে থাকে না। এই গুণাবলি অর্জন করতে হয় শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কর্মী হতে পারে অনেকেই; কিন্তু উদ্যোক্তা সবাই হতে পারেন না। সঠিক পথে অর্থ ব্যয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা খুবই কঠিন একটি কাজ। একজন উদ্যোক্তাকে সব সময় অন্যের সফলতার অনুসরণ করলে চলে না। তাকে সব সময়ই সৃজনশীল নতুন উদ্যোগের কথা ভাবতে হয়। নতুন কিছু করার জন্য ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। অর্থ আয় করার মধ্যে আনন্দ আছে। আর অর্থ ব্যয় করার মধ্যে আছে বেদনা ও যাতনা। সবাই অর্থ ব্যয় করে উদ্দিষ্ট বস্তুটি তুলনামূলক কম মূল্যে পেতে চায় অর্থ ব্যয়ের যাতনাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য। অর্থ ব্যয় করা ছাড়াই যদি চাহিদাকৃত সব বস্তু এমনতিই পাওয়া যেত, তাহলে কোনো মানুষই তার উপার্জিত অর্থ ব্যয় করতে চাইতো না।
অর্থ ব্যয় না করে যতটা সম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা। বিক্রেতারা ভোক্তাদের এই মনোভাবের বিষয়টি ভালোভাবেই অবহিত আছেন। যে কারণে তারা চেষ্টা করেন কোনো পণ্যের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করতে, যাতে ভোক্তার মানসিক কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়। তারা বুঝতে পারে পণ্যটি ক্রয় করে তারা জিতেছেন। রিচার্ড থ্যালারের গবেষণার মূল উপজীব্য এখানেই। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, বাজারে একটি পণ্যের মূল্যহ্রাস কীভাবে ভোক্তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে এবং ভোক্তা পণ্যটি কম অথবা বেশি ক্রয় করতে উদ্বুদ্ধ হন। রিচার্ড থ্যালার বলেন, তার বই বাজারে এলে ক্রেতাদের মাঝে খুব একটা আলোড়ন তুলতে পারেনি; কিন্তু যখন বাইয়ের মোট মূল্যের ওপর ২৫ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়, তখন ক্রেতারা বই কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মূল্য ছাড় উদ্দিষ্ট পণ্যের ভোক্তাদের মনোজগতে এক ধরনের স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। তারা মানসিক তৃপ্তি নিয়ে বিজয়ীর বেশে পণ্যটি ক্রয়ের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
অনেক সময় মূল্য ছাড়ের সুযোগ গ্রহণকল্পে যার পণ্যটি ক্রয়ের প্রয়োজন নেই, তিনিও তা ক্রয় করে থাকেন। অর্থাৎ মূল্য ছাড়া বিকল্প চাহিদা সৃষ্টিতেও সহায়ক। ভোক্তারা মনে মনে ভাবেন, মূল্য ছাড়ের সুযোগে পণ্যটি ক্রয় করে তিনি কতই না লাভবান হলেন। বিক্রেতারাও এক্ষেত্রে কম যান না। তারা ভোক্তার এই মানসিক অবস্থার কথা জানেন। আর জানেন বলেই তারা কৌশলে ভোক্তাদের পণ্যটি ক্রয়ের জন্য প্রলুব্ধ করে থাকেন। তারা মূল্য ছাড়ের খবরটি চারদিকে রটিয়ে দেন। কথায় বলে, ‘ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না।’ তেমনি মূল্য ছাড় দিলে ক্রেতার অভাব হয় না। বিক্রেতারা এমনভাবে পণ্যের মূল্য ছাড় দেন, যাতে তাদের মুনাফা পুরোটাই থাকে। আবার ক্রেতাদেরও আকৃষ্ট করা যায়। অনেক সময় এমনো দেখা গেছে, যে পণ্যের প্রকৃত মূল্য ১০০ টাকা সেই পণ্যের মোড়কে ১৫০ টাকা মূল্য লিখে রাখা হয়। ৫০ টাকা মূল্য ছাড় দিয়ে পণ্যটি ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ভোক্তা বা ক্রেতারা মনে করেন, তারা ১৫০ টাকার পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করে ৫০ টাকা লাভবান হয়েছেন। আসলে তারা এখানে মূল্য ছাড়ের নামে প্রতারণার শিকার হয়েছেন মাত্র। ভোক্তা লাভবান হননি বরং বিক্রেতাই লাভবান হয়েছেন। কারণ তিনি আসলে আগের মূল্যেই পণ্যটি বিক্রি করেছেন। মাঝখান থেকে মূল্য ছাড়ের নামে পণ্যটির বিক্রি বেড়েছে মাত্র। অনেক সময় মূল্য একই পরিমাণ রেখে মোড়কের ভেতরের আইটেম কমিয়ে দেয়া হয়। ভোক্তারা প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারেন না। পরে বুঝলেও কিছু করার থাকে না। কোনো কোনো কোম্পানি তাদের পণ্যের প্যাকেটের গায়ে লিখে রাখে, ‘ওয়েট ওয়ান হান্ডেড অ্যান্ড ফিফটি গ্রাম হোয়েন ম্যানুফ্যাকচার্ড।’ প্রশ্ন হলো কোম্পানি পণ্যটি তৈরি করার সময় কত গ্রাম ওজন ছিল, তা আমার জানার কোনো দরকার আছে কি? আমি জানতে চাই যখন পণ্যটি আমি ক্রয় করছি, তখন তার ওজন কত।
আমি পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে এবং চলতি বছর (২০২৩) সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। সেখানে ব্যবসায়ীদের কারসাজি প্রত্যক্ষ করি। মক্কা নগরীতে হজের আগে অধিকাংশ দোকানে প্রতিটি জুব্বার ফিক্সড রেট লিখে রাখা হয়েছিল ৭৫ রিয়াল। মোটামুটি বিক্রি হচ্ছিল। যেই না হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেল, যখন হাজিদের অনেকেই মদিনা শরিফে গমন করেন। এ সময় দোকানিরা প্রতিটি জুব্বার মূল্য ৩৫ রিয়ালে নামিয়ে আনে। এখন প্রশ্ন হলো, ৩৫ রিয়ালে জুব্বা বিক্রি করায় কি তাদের লোকসান হয়েছে? না অবশ্যই তাদের লোকসান হয়নি। ৩৫ রিয়ালে বিক্রি করলেও তাদের কিছু না কিছু লাভ হয়েছে। তাহলে তারা যখন প্রতিটি জুব্বা ৭৫ রিয়ালে বিক্রি করেন, তখন জুব্বা প্রতি তারা কত রিয়াল লাভ করেছেন। অন্তত ৪০ বা ৪৫ রিয়াল লাভ করেছেন। অথচ ইসলামি ব্যবসায়িক রীতি-নীতিতে একজন ব্যবসায়ী কোনো পণ্য বিক্রি করে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কি ইসলামি ব্যবসায়িক রীতির লঙ্ঘন হলো না? সারা বিশ্বব্যাপীই ব্যবসায়ীদের কূটকৌশলের কাছে ভোক্তারা অসহায়।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ভোক্তাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি বলে মনে করা হয়। আসলে এই কথাটি মোটেও ঠিক নয়। ভোক্তা আসলে উৎপাদন এবং বাজারজাতকারিদের হাতের মুঠোয় বন্দি। আমাদের দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে ১৯৯১ সাল থেকে; কিন্তু এখনো মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। চাহিদা ও জোগানের দ্বারা একটি পণ্যের বাজারমূল্য নির্ধারিত হবার কথা থাকলেও সব সময় তা হচ্ছে না। একটি শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেটই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে ভোক্তা যেন অসহায় ভাস্কর্য বিশেষ।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে