পাহাড়েও বেনজীরের থাবা, রয়েছে বাংলো বাড়ি-খামার
বান্দরবানের দুটি উপজেলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে রয়েছে প্রায় ১০০ একর পাহাড়ি জমি। সেই পাহাড়ি জমিগুলোতে গড়ে তুলেছেন মৎস্য ও গরুর খামার, অবকাশযাপনে বাংলো বাড়ি এবং ফলজ-বনজ বাগান। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসহায় গরীব মানুষদেরকে নামমাত্র মূল্য দিয়ে জমিগুলো দখল করেন এবং তাদেরকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা গেছে, দখল করে নেয়া পাহাড়ি জমিগুলোর জেলা সদরের সুয়ালক ইউনিয়নে রয়েছে পঁচিশ একর জমি এবং লামার ডলুছড়ি মৌজায় রয়েছে ৫৫ একর জমি। এসব জমি সাবেক আইজিপি বেনজীরের নামে। আর এই জমিগুলো নামমাত্র দামে কিনে দখল করে নিতে তাকে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা এবং দুটি মৌজার হেডম্যান।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০১৬ সালে বেনজীর আহমেদ তার স্ত্রী জীশান মির্জা ও মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের ৩১৪ নম্বর সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগে ও ৩ নম্বর শিটে ২৫ একর জায়গা লিজের ভিত্তিতে বান্দরবান পৌরসভার বাসিন্দা আবুল কাশেমের পিতা শাহজাহানের কাছ থেকে নেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লিজ নেয়া পঁচিশ একর জায়গাজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে মৎস্য ও গরুর খামার এবং পাহাড়ে অবকাশযাপনের জন্য দোতলা একটি বাংলো বাড়ি। খামারে বিক্রি যোগ্য ৩৫টি গরুও রয়েছে। সবচেয়ে বড় গরুটির দাম আড়াই লাখ টাকা বলেও জানিয়েছেন খামারের কর্মচারী। এ ছাড়াও খামারের চারপাশে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন জাতের ফলজ এবং বনজ গাছ। বাগানের প্রবেশমুখে রয়েছে আকর্ষণীয় গেইট।
এমনকি খামারে যেতে সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা। সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ সরবরাহও করা হয়েছে। আর এসব কাজে বেনজীর আহমেদকে পর্দার আড়াল থেকে সহযোগিতা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা।
অপরদিকে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার টংগঝিরিতে বেনজীরের পরিবারের নামে রয়েছে ৫৫ একর পাহাড়ি জমি। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিশ্র ফলের ও বনজ গাছের বাগান। সেখানেও তিনি তৈরি করেছেন একটি বাংলো বাড়ি। পাহাড়ের গোটা জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াতে লেগে যায় পুরোটা দিন।
মূলত জনপ্রতিনিধি ক্যশৈহ্লাতার মদদে পাহাড়ি জমিগুলো খুব সহজে বেনজীর আহমেদ নিজের এবং তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে দলিল করে নিতে পেরেছেন।
একটা সময়ে ডলুছড়ি মৌজার টংগঝিরিতে অসহায় ও গরিব অনেকগুলো পরিবারের বসতি ছিল। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশের এই সাবেক আইজিপি স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় নামমাত্র দামে গোটা ৫৫ একর জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয় এবং জমিগুলো থেকে বসবাসকারীদের সরে যেতে বাধ্য করেন। অথচ অসহায় পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ও আয়ের উৎস ছিল পাহাড়ের এই জমিগুলো।
ডলুছড়ি মৌজার অজিত ত্রিপুরা বলেন, ‘জায়গালো যখন দখল করে নিচ্ছিল তখন আমি মোটামুটি ছোট ছিলাম। তখন দেখেছি মং ওয়াইচিং এসে আমার বাবার কাছে ১ লাখ টাকা দিয়ে জোর করে ৫ একর জায়গা দখল করে নিয়েছে। একইভাবে পাড়া প্রতিবেশী অনেকের কাছ থেকে জায়গা নিয়েছে। তখন প্রতিবাদের চেষ্টা করলে লামা ও বান্দরবান থেকে পুলিশের লোকজন গিয়ে আমাদের নানাভাবে হয়রানি করত। এত দিন ভয়ে কথাগুলো কাউকে ঠিকমত বলতে পারিনি। কিন্তু পাহাড়ি নেতারা জানত, তারাও অসহায় ছিল।
ডলুছড়ি মৌজার সাবেক মেম্বার ফাইসা প্রু বলেন, আমার এলাকায় বেনজীর আহমেদ পরিবারের ৫৫ একর পাহাড়ি জমি রয়েছে। জমিগুলোতে একটা সময়ে অসহায় অনেকগুলো পরিবারের বসবাস থাকলেও বর্তমানে গোটা জায়গাটি সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার দখলে রয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ভাগিনা ও আওয়ামী লীগ নেতা মং ওয়াইচিং জায়গাগুলো পুলিশ প্রধানকে নিয়ে দিয়েছিল। বিষয়গুলো নিয়ে কোনো ধরনের কথা না বলতে নিষেধ করা হয়েছিল, নয় তো মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং বলেন, সুয়ালকের মাঝেরপাড়ায় বেনজীর আহমেদের জমির পাশে আমার কিছু জমি রয়েছে। সেই সুবাদে এক দিন এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে আমাকে বেনজীর আহমেদের জায়গাগুলো দেখাশুনা করতে বলেন। আমি তাদের জমিগুলো দেখাশোনা করতাম। কিন্তু লামার ডলুছড়ির টংগঝিরি এলাকায় জায়গা দখলের বিষয়টি আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে বান্দরবানের ডিসি শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, বেনজীর আহমেদের নামে বান্দরবান লিজের জায়গা বা জোর করে জায়গা দখল করেছেন এমন কিছু জানা নেই। তথ্যটি সম্পর্কে বিস্তারিত খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবো।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে