Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্মরণে

শত জ্যোৎস্নার মাধুরী

Swakrito  Noman

স্বকৃত নোমান

রবিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪

খন আমি মফস্বল সাংবাদিক। দুনিয়ার সবাইকে ড্যামকেয়ার করি। ইউএনও, ওসির সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াই। নিউজ করার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টাকা নিই। চোরাকারবারিদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নিই। আর লিখি কবিতা, পাশাপাশি গল্প। মাঝে মধ্যে লিখি নাটক। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সেসব নাটকের নির্দেশনা দিই। নাট্যদল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরি, পরিবেশন করি নাটক। আর সম্পাদনা করি একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথের লেখার খুঁত ধরে বেড়াই, নজরুলকে ছোট কবি বলে প্রচার করি, আর জীবনানন্দের কবিতা পড়ে কাঁদি। ভাবি, জীবনানন্দের পর আমিই বাংলা ভাষার সেরা কবি। আমার মতো মহান কবি জগতে দ্বিতীয়জন নেই।

সেসব দিনের একদিন সেলিম আল দীনের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয়ের কয়েক মাস পর একদিন ঢাকায় এলাম। হাতে নকিয়া কোম্পানির মোবাইল ফোন। সোনালি ব্যাংক থেকে ছাগল-পালনের ঋণ নিয়ে ফোনটি কিনেছি। ভাবছি, আমার হাতে ফোন! আমি কত না গুরুত্বপূর্ণ লোক! আমার গায়ে মফস্বলের গন্ধ, ভাষায় মফস্বলের টান, পান করি সানমুন সিগারেট, বেনসনকে বলি ভ্যানসন, চা-কে বলি সাঁ, ঢাকাকে বলি ডাকা। পোশাক-আশাক দেখে যে কেউ বলবে, আমি ক্ষেত থেকে উঠে এসেছি। ব্যতিক্রম শুধু চোখ। সেই চোখে দুনিয়াজয়ের স্বপ্ন।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বাস থেকে নেমে ফোন দিলাম সেলিম আল দীনকে। বললাম, ‘বস, আমি ডাকায় এসেছি। আফনার সাথে একটু দেখা করতে চাই।’ তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বিকেলে নাট্যশালায় এসো, আমি থাকব সেখানে। আমি বললাম, ‘ওকে বস। এসে আপনাকে ফোন দেব।’ এবার তিনি খেপে গেলেন। বললেন, ‘শালার পুত, তুই আমাকে বস ডাকিস কেন?’ আমি কি মাফিয়া ডন? আর কখনো বস ডাকলে তোর খবর আছে।’

আমি ভড়কে গেলাম। ‘বস’ ডাকার মধ্যে সমস্যা কোথায় বুঝতে পারছি না। কীভাবে বুঝব? আমি তো সভ্যতা বুঝি না, ভব্যতা বুঝি না, ভদ্রতা বুঝি না। কাকে কী বলে সম্বোধন করতে হয়, জানি না। মন খারাপ করে ফোন দিলাম কবি সিদ্ধার্থ শংকর ধরকে। বললাম বস ডেসে সেলিম আল দীনের ঝাড়ি খাওয়ার ঘটনা। সিদ্ধার্থ বললেন, ‘বস ডাকলেন কেন? স্যার ডাকবেন, স্যার।’ তিনি অভয় দিলেন, ‘সমস্যা নেই, আপনি বিকেলে স্যারের সঙ্গে দেখা করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আমি একজন বিশিষ্ট নির্বোধ হতে পারতাম। একজন চোরাকারবারি হতে পারতাম। একজন মফস্বল সাংবাদিক হয়ে থাকতে পারতাম। চোরাকারবারিদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নিয়ে সংসার চালাতে পারতাম। কয়েকশ টাকার জন্য হন্যে হয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে পারতাম, তাদের চামচামি করতে পারতাম, তেলবাজি করতে পারতাম। বড় জোর ধারদেনা করে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে অর্থোপার্জনে গিয়ে প্রবাসী শ্রমিক হতে পারতাম।

না, আমি তা হইনি। হতে দেননি সেলিম আল দীন। তিনি মানুষের দায়িত্ব নিতে পারতেন। অনুজদের মাথার ওপর হাত রাখতে পারতেন। যে কোনো দুঃসময়ে অভয় দিতে জানতেন। তিনি আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে সাহিত্যের পাঠ দিয়েছেন, বিশ্বসাহিত্যের পাঠ দিয়েছেন। তিনি আমাকে প্রজ্ঞার পথে চালিত করেছেন।

এই ক্ষুদ্রজীবনে সেলিম আল দীনের মতো এমন বহুমাত্রিক মানুষ আমি আর দেখিনি। এখনো আমি মাথার ওপর একটি হাত খুঁজি। গুরুর হাত, বরাভয়ের হাত, আশীর্বাদের হাত, সান্ত্বনার হাত, সাহসদানের হাত। কোথাও তা পাই না খুঁজে। মানুষের দায়িত্ব নিতে পারার মতো মানুষ এখন আর খুঁজে পাই না৷ সারা জীবন মাথার ওপর কেবল দুটি হাতের পরশ পেয়েছি। একটি জন্মদাতার, একটি পুনর্জন্মদাতার। একজন পিতা, অন্যজন গুরু।

আজ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের প্রয়াণ দিবস। তিনি সবসময় আমার স্মরণে থাকেন। তবে আজ তাকে বিশেষভাবে স্মরণ করবার দিন। স্মরণ করা আমার কর্তব্য। কেননা আমি অকৃতজ্ঞ নই। শ্রদ্ধা জানবেন গুরু। আপনার দিব্য চরণতলে চিরকাল আমার ঠাঁই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ