Views Bangladesh Logo

বাঙালি লেখকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ

Zakir  Talukder

জাকির তালুকদারএর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার

জাকির তালুকদার বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক। তার আলোচিত উপন্যাস পিতৃগণ, মুসলমানমঙ্গল, কবি ও কামিনী, কুরসীনামা, ১৯৯২ ইত্যাদি। প্রায় ২৫টি উপন্যাস ও শতাধিক ছোটগল্প লিখেছেন তিনি। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন। ‘কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন’ তার একটি আলোচিত গ্রন্থ। ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন; কিন্তু ১০ বছর পর ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ইস্যু নিয়ে সবসময়ই সরব এবং প্রতিবাদমুখর এ কথাসাহিত্যিক। প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনষ্ক এই লেখক পেশায় চিকিৎসক। অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ শুরুতেই কিছু সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বইমেলা ও দেশের বর্তমান নানা পরিস্থিতি নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হলো স্বনামধন্য এ লেখকের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক কামরুল আহসান

ভিউজ বাংলাদেশ: প্রথমে এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বলুন। ঘোষণা দেয়ার পরও পুরস্কার স্থগিত করা হলো, পরে তিনজন লেখকের পুরস্কার বাতিল করা হলো। কথাসাহিত্যে, শিশুসাহিত্যে এবং মুক্তিযুদ্ধে এবার কাউকে পুরস্কার দেয়া হলো না। কেমন হলো ব্যাপারটা?

জাকির তালুকদার: সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বাংলা একাডেমির নির্লজ্জতার ব্যাপার তো আজকের ব্যাপার নয়। সেই নির্লজ্জতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটল এ বছর। বাংলা একাডেমির যে গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, গঠনতন্ত্র না মেনে ইচ্ছা মতো পরিচালনার যে মাৎস্যন্যায় ব্যবস্থা তার প্রতিবাদ করার জন্য ১০ বছর ধরে আমি কথা বলেছি এবং শেষে পুরস্কার ফেরত দিয়েছি। এগুলো আসলে কোনোটাই কোনো কাজে লাগেনি। বোঝা যাচ্ছে কোনো ভদ্রলোকের কথা বা ভদ্র আচরণ এদের কাছে কাম্য নয়। মব দেখে এরা পুরস্কার স্থগিত করেছে। এখন এই মবটাও তারা নিজেরাই আয়োজন করেছে কি না কে জানে। আমার সন্দেহ ওরা নিজেরাই আয়োজন করেছে।

একজন উপদেষ্টা বা মন্ত্রীর এখতিয়ার নাই একটা পুরস্কার ঘোষণার পর তা স্থগিত করা। পুরস্কার স্থগিত করা হলো, কারণ, লেখকদের কাছে আমরা যে প্রকার মেরুদণ্ড আশা করি সেটা না থাকার ফলাফল এটা। পুরস্কার স্থগিত করার পর ঘোষণাপ্রাপ্ত সব লেখকেরই উচিত ছিল এই বিবৃতি দেয়া যে, আমরা এই পুরস্কার নেব না। সেই মেরুদণ্ডটা আমাদের লেখকরা দেখাতে পারেননি। সেই কারণেই বাংলা একাডেমি এরকম নির্লজ্জ কাজ করতে পারছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও বেশি নির্লজ্জ কাজ করতে থাকবে। আমার ঘৃণা প্রকাশের ভাষা নাই। এ ব্যাপার নিয়ে আমি নিজেই লজ্জিত।

ভিউজ বাংলাদেশ: যারা পুরস্কার নির্বাচনের কমিটিতে ছিলেন, তাদের নাম প্রকাশ হলো না, পরবর্তীতে যারা স্থগিত করলেন তারাই-বা কারা? এর জন্য কি বাংলা একাডেমির কাছে লেখকদের জবাবদিহি চাওয়া দরকার কি না?

জাকির তালুকদার: অবশ্যই জবাবদিহি চাওয়া উচিত। দাবি করা উচিত এবং আদায় করা উচিত। কোনো জবাবদিহি করতে হয় না বলেই তো বাংলা একাডেমি আজকের মতো এরকম নোংরা একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: পুরস্কার স্থগিত করার পর কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। পরবর্তীতে তার নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এটা কি বাংলা একাডেমি ঠিক করেছে?

জাকির তালুকদার: যেখানে পুরস্কার স্থগিত করাটাই অনুচিত, যেখানে বাকি সব কার্যক্রম- পুনঃতালিকা করা বা পুনঃনির্বাচন করাই তো অবৈধ বলে মনে হয় আমার কাছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: এবার বইমেলার শুরুতেই পুলিশ মন্তব্য করছে বইমেলায় যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় এমন কোনো বিষয়বস্তু ঠেকাতে বই প্রকাশের আগেই যেন বাংলা একাডেমি পাণ্ডুলিপি যাচাই করে। পুলিশের এহেন মন্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

জাকির তালুদকার: বাঙালি লেখকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। একটা পুলিশ হলো রাষ্ট্রের পুলিশ, আরেকটা পুলিশ হলো সাহিত্যের পুলিশ। কিছু সোকল্ড ব্যাকওয়ার্ড নীতিবাগিশ যারা এই লেখা যাবে না, ওই লেখা যাবে না- এরকম করে করে সাহিত্যকে স্বাধীন পথে চলতে যতদূর সম্ভব বাধা সৃষ্টি করেছে। পুলিশ তো শিক্ষিত নয়। রাষ্ট্রীয় পুলিশ তো আর সাহিত্য বিচার করতে জানে না। এরকম সাহিত্যের পুলিশদের কথা শুনেই কোনো কোনো লেখককে, কোনো কোনো বইকে তারা নিষিদ্ধ করেছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বিগত সরকারের আমলেও আমরা এরকম কাণ্ডকারখানা দেখেছি। বিভিন্নজনের কথায় বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু পুলিশ কেন, সাহিত্যের ক্ষেত্রে সরকার, রাষ্ট্র, অভিভাবক কারও কোনো ভূমিকা নেই। সাহিত্য কেবল সাহিত্য দিয়েই বিচার্য। লেখা যদি কারও অপছন্দ হয়, পড়বে না বা আপত্তি থাকলে লেখা দিয়েই তা প্রকাশ করবে। আর কোনটি উসকানিমূলক এটা কে কীভাবে নির্ধারণ করবে?

যদিও আমাদের ধর্মের কথাটাই এখানে বারবার বলা হচ্ছে, তো ধর্মে তিয়াত্তরটা ফেরকা আছে, এক ফেরকার লোকের কাছে যা উসকানিমূলক মনে হবে, ৭২ ফেরকার লোকের কাছে তা উসকানিমূলক নাও মনে হতে পারে। তাহলে এই জিনিসটা আপেক্ষিক। অতএব, যেটা তারা করতে পারে, কোনো বই প্রকাশিত হলে সেই বইয়ের বক্তব্যের সঙ্গে তাদের যদি দ্বিমত থাকে, পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা আরও একটা বই লিখতে পারে। বা একাধিক বই লিখতে পারে, সেগুলোর জবাব দিতে পারে।

কিন্তু তা না করে, পুলিশি হস্তক্ষেপ কামনা করে লেখকের স্বাধীনতা, সাহিত্যের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা- এগুলোকে সংকোচিত করার যে চেষ্টা, এই চেষ্টাটা ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু আছে, এখন তা আরও বাড়ছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর আমরা আশা করেছিলাম, দেশে একটা মুক্তচিন্তার প্রবাহ তৈরি হবে। কিন্তু সেটি না হয়ে যথারীতি আগের যে অসুস্থ নিয়মগুলো চালু ছিল সেই নিয়মগুলোই এখন আরও বেশি করে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সঙ্গে শুরু হয়েছে মব লেলিয়ে দেয়া। আমি একেবারে সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, পুলিশের কোনো অধিকার নেই এরকম কথা বলার।

ভিউজ বাংলাদেশ: এখন লেখকরা কি পুলিশের কাছে জবাবদিহি চাইতে পারে, বা সরকারের কাছে অভিযোগ তুলতে পারে যে পুলিশ কেন এরকম কথা বলবে? এটা পুলিশের কাছ থেকেই একটা উসকানিমূলক মন্তব্য মনে হচ্ছে না?

জাকির তালুকদার: লেখকরা অন্তত প্রথমে একটি বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে। যে পয়েন্টটা নিয়ে পুলিশ কথা বলেছে তারা সেই পয়েন্টা বাতিলের দাবি তুলতে পারে। আর যে কথাগুলো বললাম, যদি কোনো বই নিয়ে কারও আপত্তি থাকে তারা পাল্টা বই লিখতে পারে। এটাই হলো সাহিত্যের এগিয়ে যাওয়ার পথ। পুলিশি হস্তক্ষেপ কোনোমতেই কাম্য না এবং পুলিশি হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার সাহিত্যে নেই।

ভিউজ বাংলাদেশ: রাষ্ট্রীয় পুলিশের সঙ্গে আমাদের দেশে যে মোরাল-পুলিশিং চলছে, ব্যক্তির স্বাধীনতায় নানাভাবে হস্তক্ষেপ চলছে- এ নিয়ে কিছু বলুন।

জাকির তালুকদার: মোরাল-পুলিশিং ঘটার পেছনে সরকারের সহযোগিতা আছে বলে আমার সন্দেহ। সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ এতগুলো মাজার ধ্বংস হওয়ার পরও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ওরস বন্ধ করার জন্য ফেসবুক লাইভ করে ঘোষণা দিয়েছে- এ সাহস তারা কোথায় পেয়েছে? তাকে গ্রেপ্তার না করে সরকার চুপচাপ বসে থাকে, ৮০টির বেশি মাজার ধ্বংস করা হয়েছে, উরস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করা হয়েছে, অন্য খেলাধুলাও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে- এগুলোর পেছনে কারও কারও প্রচ্ছন্ন মদদ আছে। তারা অন্তর্ভুক্তির কথা বলছে বটে; কিন্তু টেনে নিয়ে আসছে ‘জাগ্রত জনতা’ বা এরকম জনগোষ্ঠীকেই। উগ্রতাকেই তারা একধরনের সমর্থন দিচ্ছে। আদিবাসীদের ওপর হামলাও আরেকটা ব্যাপার। এগুলোর কোনোটারই বিচার হচ্ছে না। দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সত্যি সত্যি শঙ্কিত হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ এখন সমাজে বিরাজ করছে। একজন লেখক হিসেবে আমি এতে উদ্বিগ্ন।

ভিউজ বাংলাদেশ: শঙ্কিত হওয়ার মতো যথেষ্ট বিষয় আছে; কিন্তু একজন লেখক হিসেবে আপনি কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন কি না? যেহেতু এখন একপ্রকার রাষ্ট্র সংস্কার চলছে, নতুন আলাপও হচ্ছে। দেখা গেছে এরকম গণঅভ্যুত্থানে পর একটা রাষ্ট্রে অনেক নতুন চিন্তার জোয়ারও আছে। আমাদের দেশে কি সেটা আসার সম্ভাবনা আছে কোনোভাবে?

জাকির তালুকদার: নতুন চিন্তার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু প্রতিকূল ঘটনা এত বেশি বহমান যে, নতুন চিন্তার কথাটা পৌঁছুচ্ছে না সবার কাছে। প্রতিকূল ঘটনার তুলনায় নতুন চিন্তা খুব ক্ষীণ শব্দ। প্রগতিশীলতার পক্ষে, মুক্তচিন্তার পক্ষে, নতুন সমাজ গঠনের পক্ষে আমাদের মিডিয়াগুলোর যে ধরনের ভূমিকা নেয়ার কথা সে ধরনের ভূমিকা নিতে পারছে না, বা নিতে চাচ্ছে না। আমাদের যারা নতুন চিন্তার অধিকারী মিডিয়া তাদের উৎসাহ জোগাতে পারত। সে রকম কিছু তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। মিডিয়া হয়তো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, আমাদের প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে তারপর জানাচ্ছে; কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, মিডিয়া নিজেই অগ্রসর হয়ে কোনো ভূমিকা পালন করছে না। তবে, খারাপ আর কতদূর খারাপ হবে একটা দেশের? সেখান থেকে ফিরে আসবেই এই দেশ।

ভিউজ বাংলাদেশ: লেখকদের তো সবসময়ই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। তো সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? আমাদের দেশের লেখকদের মেরুদণ্ড কতখানি শক্ত বলে আপনার মনে হয়?

জাকির তালুকদার: বাংলাদেশের কিছু লেখকদের সবসময়ই সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে, তাল মিলিয়ে চলার অভ্যাস আমরা দেখেছি। তবে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেভাবে দেশের সব লেখক সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন সেরকম আগে কখনো দেখিনি। তারই জের বোধহয় এখনো চলছে। লেখকের স্বাধীন চিন্তা বা স্বাধীন সত্তা আসলে নষ্ট হয়ে গেছে। তখনো যারা সরব ছিলেন, বিশেষ করে বামপন্থি কিছু লেখক, তারা আগেও সরব ছিলেন, এখনো তারাই সরব আছেন। সংখ্যাটা হয়তো এখন কম। কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়বে বলে আমি আশা করি।

ভিউজ বাংলাদেশ: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আপনি প্রচুর সমালোচনা করেছেন, এমন অনেক সাহসী মন্তব্য করেছেন যেটা বিপজ্জনক ছিল, এখনো আপনি সেটা করছেন, যদিও একটা বিশেষ মহল আপনাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলারও চেষ্টা করছে, এতে আপনি কোনোরকম হুমকির মুখোমুখি হন কি না? এই সাহসাটা আপনি কোথায় পান?

জাকির তালুদকার: হুমকি সব সময়ই থাকে। বিবেকই লেখকের সাহস। আমার ক্ষেত্রে হয়তো এরকম হতে পারে, সঠিক ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে, সঠিক পাঠচক্রের মাধ্যমে, সঠিক মানুষগুলোর সম্পৃক্ততার মাধ্যমে যেভাবে বেড়ে উঠেছি এবং আমার সংস্পর্শের মানুষগুলো- আমার পরিবারের কাছ থেকে আমি যে সমর্থনটা পাচ্ছি সেটাই হয়তো আমার সাহস। যেমন আমার ছেলেকে আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম- বাবা, আমাকে যদি জেলে ভরে তুমি কি লজ্জিত হবে? আমার সন্তান খুব অবলীলায় বলে দিল, বরং আমরা গর্ববোধ করব।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ