যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য বাংলার আত্মত্যাগ
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় ৪ জুলাই। ১৭৭৬ সালে এই দিনে আমেরিকা মহাদেশের ১৩টি কলোনি ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৭৭৭ সালের ৮ জুলাই ফিলাডেলফিয়া শহরে প্রথম ৪ জুলাইয়ের স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশের মানুষ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন অন্যান্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। আর সেই অর্থ সংস্থানের জন্য উপনিবেশগুলোর ওপর কর বৃদ্ধি করছিল। ১৭৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৭৭০-এর দশকের প্রথম দিকে ব্রিটিশদের দুটি যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
একটি পূর্ব বাংলায় আরেকটি পশ্চিমে ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশের বিরুদ্ধে। দুটি যুদ্ধ চালানোর খরচ বিপুল। ব্রিটিশ সরকারের তহবিল প্রায় শূন্য। তাই ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশগুলোতে কর বৃদ্ধি করল। আমেরিকান উপনিবেশের নেতারা অতিরিক্ত ট্যাক্স গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। তাই তারা ‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কোনো কর না’ আন্দোলন শুরু করেছিল। বাংলা থেকে যে চা গ্রেট ব্রিটেন হয়ে আমেরিকায় যেত, ব্রিটিশ সরকার তার ওপর টাউনসেন্ড ট্যাক্স আরোপ করে। আমেরিকান বিপ্লবীরা এর প্রতিবাদ করে। তারা বোস্টন হারবারে চায়ের বাক্স ফেলে দেয়। প্রতীকীভাবে যা ‘বোস্টন টি পার্টি’ নামে পরিচিত।
যেহেতু ব্রিটিশরা দুটি যুদ্ধ পরিচালনা করতে অসুবিধায় পড়েছিল, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট তার মন্ত্রিসভাকে যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য একটি সমাধান নিয়ে আসতে বলেছিলেন। ক্যাবিনেট কমিটি প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিটকে ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশকে স্বাধীনতা দিতে পরামর্শ দিয়েছিল। বরং আমেরিকা থেকে সরে এসে বাংলায় তাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করার সুপারিশ করেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে যে অর্থ উপার্জন করেছিল তা সম্মিলিতভাবে ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ক্যারিবিয়ান এবং কানাডার মিলিত অর্থের চেয়ে বেশি। ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ক্যারিবিয়ান এবং কানাডা থেকে প্রতি বছর ব্রিটিশ কোষাগার প্রায় ৪ লাখ পাউন্ড স্টার্লিং রাজস্ব পেয়ে আসছিল।
এর বিপরীতে, তারা বাংলা থেকে ১০০ গুণ বেশি রাজস্ব পাচ্ছিল। বার্ষিক প্রায় ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং। তাই প্রধানমন্ত্রী ১৭৭৬ সালে আমেরিকান উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা প্রদান করেন। বিপরীতে বাংলার মানুষকে আরও শক্ত পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট জুনিয়রকে সম্মানিত করার জন্য আমেরিকানরা তাদের বিখ্যাত লৌহ শিল্প শহরের নাম রাখে পিটসবার্গ। একজন আমেরিকান পণ্ডিত, এশিয়া ফাউন্ডেশনের জেমস নোভাক, উল্লেখ করেছিলেন যে, ‘বাংলার আত্মত্যাগের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা এসেছে।’ (নোভাক, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ১৯৪-৯৭)
প্রায় ২০০ বছর পর, ১৯৭১ সালে যখন বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল তখন আমেরিকার আইন প্রণেতা, সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান, আমেরিকান পণ্ডিত, অধ্যাপক, ডাক্তার, আমেরিকান কূটনীতিকসহ বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন। ঢাকায় অবস্থানরত আমেরিকান কূটনীতিক আর্থার কে ব্লাড এবং তার সহকর্মীরা পাকিস্তানি গণহত্যা ও নৃশংসতার বর্ণনা দিয়ে মার্কিন সরকারের কাছে তার বিখ্যাত ব্লাড টেলিগ্রাম পাঠান। হার্ভার্ডের অধ্যাপক জন এডওয়ার্ড ম্যাসন, প্রফেসর মারগ্লিন এবং ডেভিড ডরফম্যান প্লাস প্রফেসর হানা এবং গাস পাপানেক, যারা পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞ ছিলেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে একটি বাস্তবতা।’ প্রশ্ন হচ্ছে, কী মূল্যে, আর কত প্রাণের মূল্যে।
যত শিগগির নিক্সন-কিসিঞ্জারের মার্কিন প্রশাসন এটি উপলব্ধি করবে, তত দ্রুত সবার জন্য মঙ্গল হবে। জনপ্রিয় আমেরিকান গায়ক এবং সংগীতজ্ঞ জর্জ হ্যারিসন, জোয়ান বায়েজ, রবিশঙ্কর এবং অন্যরা জনসচেতনতা বাড়াতে এবং শরণার্থীদের জন্য তহবিল বাড়ানোর জন্য নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার বাগানে একটি কনসার্টের আয়োজন করে। যা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত। তাদের সঙ্গে হাজারো মানুষ কণ্ঠ মেলায়, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’...।
নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিল। তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশে) গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়েছিল। মার্কিন আইন প্রণেতারা সমস্ত আমেরিকান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছিল। পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের চালান আটকানোর জন্য একের পর এক বিল এনেছে। বাল্টিমোর এবং ফিলাডেলফিয়ার নারী-পুরুষরা তাদের শতাধিক ছোট নৌকা এবং ছাউনি নিয়ে পাকিস্তানের জন্য অস্ত্রবোঝাই জাহাজের পথ বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশি হিসেবে আমরা তাদের জন্য গর্বিত। আমরা তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল; কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা আমাদের বিজয় লাভ করি। মার্কিন সরকার শিগগিরই আমাদের স্বীকৃতি দেয়। ১৬টির মধ্যে ১৫ বার জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য তারা আমাদের বিডকে সমর্থন করেছিল (একবার বিরত ছিল)। শুধু তাই নয়, আমাদের স্বাধীনতার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দাতা। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুমুখী এবং তারা আমাদের আরএমজির বৃহত্তম আমদানিকারক এবং সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী।
আমরা আমেরিকানদের মতোই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্ম, বাক ও মিডিয়ার স্বাধীনতার একই মূল্যবোধ এবং নীতিগুলো ভাগ করি। বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ প্রাণ দিয়েছে। আমেরিকানরা যখন ৪ জুলাই তাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে, আমরাও তাদের সঙ্গে আরও ভালো, আরও মানবিক এবং সবার জন্য আরও শান্তিপূর্ণ বিশ্বের জন্য যোগ দেব।
লেখক: সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে