বাইডেন-নেতানিয়াহুর সম্পর্ক এবং গাজা যুদ্ধে এর প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে সম্পর্কের বর্ণনা দেয়া খুবই জটিল। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার দাবি তুলেছেন। এর জন্য গত ২০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে ইহুদি ঐতিহ্যের একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় আইসিসি প্রসিকিউটরের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। বাইডেন স্পষ্ট বলেছেন, ‘আমি পরিষ্কার বলছি, ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য আমরা আইসিসির আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছি।’ তিনি জোর দিয়ে আরও যোগ করেছেন, ‘ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না।’ তিনি আরও ঘোষণা করেছেন যে, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ গণহত্যা নয়। এর মানে কি এই যে, বাইডেন আসলে নেতানিয়াহু আর তার জোট সরকারকে সমর্থন দিচ্ছেন? মোটেই না।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসরণ করছেন, যে কোনো মূল্যে ইসারায়েল রাষ্ট্রকে সমর্থন দেবেন, নিরাপত্তা দেবেন; কিন্তু মুদ্রার অন্য অংশে ভিন্ন চিত্র, ইসরায়েল যদি দক্ষিণ গাজার রাফাতে প্রবেশ করে, তাহলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন বাইডেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ হুমকি কানে তোলেননি। এরই মধ্যে বাইডেন একটি বোমার চালান বন্ধ করেছেন। এই চালানে ছিল ১ হাজার ৮০০টি ২০০০ হাজার পাউন্ড (৯০৭ কেজি) এবং ১ হাজার ৭০০টি ৫০০ পাউন্ড (২২৭ কেজি) ওজনের বোমা। এতে যে নেতানিয়াহু খুব দমে গেছেন তাও নয়, তিনি বলেছেন, ‘ইসরায়েল একাই লড়বে। যুক্তরাষ্ট্র যদি অস্ত্রের চালান বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমাদের যা আছে তা-ই নিয়ে লড়ব।’ আরও অনেক ইসরায়েলি আইনপ্রণেতা বাইডেনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলের একক বৃহত্তম সমর্থক এবং সামরিক তহবিল ও অস্ত্রের জোগানদাতা। তারপরও ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে বাইডেনের এই সিদ্ধান্তে, অস্ত্রের চালান বন্ধ করে দেয়ায় তাদের রাফা অভিযানের পরিকল্পনায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।
কেউ কেউ মনে করেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের এই মতানৈক্য, বিক্ষোভ ও দাঙ্গা আসলে নেতানিয়াহুর সরকারকে টেনে নামানোর বাইডেন প্রশাসনের একটা পরিকল্পনা। নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধ-বিক্ষোভে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর! কেন? পাশের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে আপত্তি জানিয়ে মানবিক সহায়তায় আপত্তি করছেন বলে বাইডেনের কারণে নেতানিয়াহুকে হতাশ মনে হচ্ছে। তা ছাড়া, গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো না দেয়ার, ২৫ মার্চ বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বাইডেন এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়েছে।
নানা কারণেই এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নতুন একটি আঞ্চলিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলে নেতানিয়াহু ও তার সরকারে পরিবর্তন চায়। মার্কিন নীতির এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক বলেই বিশ্বাস হচ্ছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহু বাইডেনের সঙ্গে খোলাখুলি একটা বোঝাপড়ায় যেতে চান। উভয় পক্ষই এখন একে-অপরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নেতানিয়াহু দ্বিদলীয় সহযোগিতার দীর্ঘস্থায়ী নীতি পরিত্যাগ করেছেন, রিপাবলিকানদের ওপর প্রবলভাবে ঝুঁকেছেন, যখন বাইডেন এবং তার মিত্ররা ইসরায়েলে নতুন প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের জন্য পরিষ্কার বা পরোক্ষভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করেছেন।
বাইডেন ও নেতানিয়াহুর টানাপোড়নের সম্পর্ক নতুন নয়। তাদের মতানৈক্য, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কৌশল ঐতিহাসিকভাবেই অনেক গভীরে। চলমান দ্বন্দ্ব-সংকট যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলি সম্পর্ককে যেমন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তেমনি ইসরায়েলের রাজনৈতিক জটিলতাকেও ফুটিয়ে তুলেছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর নেতানিয়াহুর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসা। নেতানিয়াহু তখন ফিলিস্তিন ইস্যু এবং ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার ছিলেন, ওবামার সঙ্গে তিনি প্রকাশ্য মত-বিরোধেও জড়িয়ে ছিলেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান করার লক্ষ্যে ওবামা নেতানিয়াহুকে জনসমক্ষে দুই রাষ্ট্র ধারণাটি গ্রহণ করার জন্য চাপ দেন। বার ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতায় ওবামা এ কথা বলেছিলেন।
শেষবার জো বাইডেনে এবং বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে জনসমক্ষে বর্তমানের মতো তীব্র দ্বন্দ্ব হয়েছিল ১৪ বছর আগে। ২০১০ সালের মার্চ মাসে বাইডেন জেরুজালেম গিয়েছিলেন, নেতানিয়াহুর সঙ্গে ওবামার শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে। জেরুজালেম গিয়ে বাইডেন বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার ৩৩ বছরের পুরোনো বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত জর্জ মিচেল ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি আলোচনা যখন পুনরায় শুরু করেন, তখন ওবামা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণের কাজ স্থগিত করতে চেয়েছিলেন, ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য জমি সংরক্ষণের জন্য; কিন্তু বাইডেন জেরুজালেমে পা ফেলার পর নেতানিয়াহুর সরকার হঠাৎ করে ওই বিতর্কিত অঞ্চলে ১ হাজার ৬০০ নতুন ইসরায়েলি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের ঘোষণা দেন। এটা বাইডেনকে অত্যন্ত অপমানিত ও ক্ষুব্ধ করে। এর প্রতিশোধ নিতে বাইডেন সেবার তার প্রিয় বন্ধুকে রাতের ডিনারে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষমান রাখেন।
সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজায় আক্রমণ চালানোর বিষয়ে নেতানিয়াহুকে বাইডেন কয়েক দফা সংযম স্থাপনের কথা বলেছিলেন; কিন্তু, বাইডেনের কথা কান দেননি নেতানিয়াহু, তাই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইসরায়েলি জনগণের ওপরই নজিরবিহীন চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি ইসরায়েলে বসতিস্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। নেতানিয়াহুর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বেনি গ্যান্টজকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করার জন্য। হোয়াইট হাউস এ সময় একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মেমো জারি করে। যাতে শর্ত ছিল ইসরায়েলকে সামরিক সাহায্য বন্ধ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই অর্থ ব্যয় করবে মানবিক সহায়তায়।
বেনি গ্যান্টজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের পর পরই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একটি নতুন সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ গাজা-সংঘাত নিয়ে ইসরায়েলি জনগণের ক্ষোভ বেড়েছে। নেতানিয়াহু তিন সপ্তাহের মধ্যে গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী শাসনের পরিকল্পনা জানাতে ব্যর্থ হলে সিনিয়র মন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ ইসরায়েলের জোট সরকার ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এই হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুকে একটি কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। গ্যান্টজের পরামর্শ গ্রহণ করা মানে অতি ডান অংশীদারদের সমর্থনকে মূল্য দেয়া, যা নেতানিয়াহুর সরকারকে সম্ভাব্য পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এই বছরের নভেম্বরে পরবর্তী মার্কিন নির্বাচন, সে পর্যন্ত নেতানিয়াহু তার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বদ্ধপরিকর। তিনি আশা করছেন, মার্কিন প্রশাসনে পরিবর্তন আসবে, ট্রাম্প আবার ফিরে আসবেন। আমার মনে হয়, সে পর্যন্ত গাজা যুদ্ধ চলবে।
মহসীন হাবিব: লেখক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে