Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বিহারি ক্যাম্প অশান্ত হওয়ার নেপথ্যে

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

স্বীকৃতির ১৬ বছর পরেও বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের বেশিরভাগই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। বরং এখনো মাদক কারবারিসহ নানা অপরাধ ও সন্ত্রাসে জড়াচ্ছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর একাধিক পক্ষের আধিপত্যের লড়াইয়ের কারণে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের ক্যাম্পগুলোতে। কেন তারা অপরাধে জড়াচ্ছেন, কেন তারা একাত্ম হতে পারছেন না বাংলাদেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, সে বিষয়টি অনুসন্ধান করেছে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’।

এর আগে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পায় আটকেপড়া পাকিস্তানিরা। তবে রায়ে বলা হয়, ওই রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এই রায়ের মধ্য দিয়ে আটকেপড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের বাংলাদেশে নাগরিকত্ব অধিকার নিশ্চিত হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় একাত্ম হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই উর্দুভাষী নাগরিকরা সাধারণভাবে বিহারি হিসেবে পরিচিত।

হঠাৎ আলোচনায় বিহারিরা
৫ আগস্ট সরকার পতনের রাত থেকেই মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে চলছে আধিপত্যের লড়াই। এতে ৬ আগস্ট একজনসহ এ পর্যন্ত গুলিতে মারা গেছেন ছয়জন। আর গত শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) ভোরে বোমার আঘাতে মারা যান আরও একজন। নিহত সাতজনের মধ্যে একজন শিশু ও একজন সাধারণ বিহারি আর বাকি পাঁচজনই মাদক কারবারি। মাদকের থাবায় জর্জরিত ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দারা জানান, গত তিন মাসেই মাদক কারবারি গ্রুপগুলোর মধ্যে ঘটেছে অন্তত অর্ধশতাধিক লড়াই।

এতে আতঙ্কিত সাধারণ বিহারিরা। তারা জানান, মাদক কারবারিদের গডফাদার ভূঁইয়া সোহেল ওরফে মুনিয়া সোহেল, মনু ওরফে পারমনুর, চুয়া সেলিম এবং জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছটুর ছেলে ইমতিয়াজের গ্রুপগুলো এই আধিপত্যের লড়াইয়ে নেমে আইনশৃঙ্খলারও অবনতি ঘটাচ্ছে। সাত নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ভূঁইয়া সোহেলের পৃষ্ঠপোষক শীর্ষ সন্ত্রাসী যোসেফ আর অপকর্মের সঙ্গী তার দুই ভাই রানা ও টুনটুনসহ সৈয়দপুরিয়া গ্রুপের বম, নওশাদ ও বাবুরা। তারা নিজেরাও মাদক কারকারি এবং বেশ কয়েকটি মামলার আসামি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে মোহাম্মদপুরে ৪ আগস্ট গুলিতে নিহত হন ১৬ বছরের শিশু ওমর ফারুক। এ হত্যা মামলায় জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি চুয়া সেলিম ও কলিম জাম্বুকে আসামি করা হয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা এবং গণভবন লুট করে মাদক কারবারিরা। তিন জায়গা থেকেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসেন তারা, যা দিয়ে ওই রাত থেকেই শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। সরকার পতন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে আধিপত্যের এই লড়াই ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে গড়াচ্ছে বলেও জানান সাধারণ বিহারিরা।
শঙ্কায় মিরপুরের বিহারিরাও
মাদক কারবারির মধ্যে মোল্লা বশির ও বুনিয়া সেলিমের মাধ্যমে মাদকের ভয়াল থাবায় জর্জরিত মিরপুর ক্যাম্পের বিহারিরাও। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের চলমান আধিপত্যের লড়াই এবং সংঘর্ষের জেরে আতঙ্কিত তারা। সরকার পতনের পর বস্ত্র, স্যানিটারি এবং ইলেক্ট্রনিকসহ কিছু নতুন ব্যবসায় জড়ানোর আশা করছিলেন যারা, তারাও এখন শঙ্কায় বলে জানান, মিরপুরের বগুড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. আমানত। তবে মিল্লাত ক্যাম্পের পঞ্চাশোর্ধ্ব জহির আব্বাস জানান, জেনেভা ক্যাম্প এবং মিরপুরের ক্যাম্পগুলোর পরিচালনা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই মাদক ব্যবসার বাজে প্রভাব থাকলেও জেনেভা ক্যাম্পের মতো এখানে সংঘর্ষ হয় না।

মিরপুরে ২০টির মতো ক্যাম্প আছে। এখানকার স্থানীয় বিবাদের বেশিরভাগ ক্লাবের মাধ্যমেই নিষ্পন্ন করা হয়ে থাকে। রাজনৈতিক প্রভাবও কম। কারণ, রাজনৈতিক কাজে বিহারিদের ক্যাম্পের মাধ্যমেই নিতে হয়। ‘বাইরের কেউ আমাদের নেতা নন’- জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর উল্টো চিত্র জেনেভা ক্যাম্পে। সেখানে পার্টি অফিস আছে এবং তারা কাউন্সিলর, এমপির হাতের পুতুল। বাইরের প্রভাবেই সেখানে এত সংঘর্ষ।’

বার বার অপরাধে জড়ানো বিহারিরাও চান মুক্তির নতুন পথ
মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডকেন্দ্রিক ঘনবসতিপূর্ণ জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ৪০ হাজার লোকের বসবাস। নয়টি সেক্টরে বিভক্ত ক্যাম্পটির ভেতরে চলাচলে রয়েছে ৩০টির মতো সরু রাস্তা। আট থেকে ১০ ফুট সাইজের ঘরের একতলা, দোতলা ও তিনতলা ভবনে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন বাসিন্দারা। একদিকে ঘনবসতি, অন্যদিকে চারদিকে খোলা হওয়ায় ক্যাম্পটি এখন মাদক কারবারের অভয়ারণ্য। বাবর রোড, হুমায়ুন রোড, গজনবী রোড এবং জাকির হোসেন রোডে মাদক ব্যবসার অন্তত ২৮টি বড় স্পট রয়েছে। প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে মাদক।

একই কারণে মিরপুরেও প্রসারিত হয়েছে মাদক ব্যবসা। তবে মাদক ব্যবসা বিহারিদের মূল পেশা নয়। নাপিত এবং কসাইগিরি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন বেশিরভাগ বিহারি। নাগরিকত্ব পাওয়ায় তাদের কাজের ক্ষেত্রও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। জেনেভা ক্যাম্প পরিচালনাকারী এনএলআরসি এবং ইস্ট্রেন্ডেড পাকিস্তানি জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটি (এসপিজিআরসি) সূত্র বলছে, বিহারিরা বার বার অপরাধে জড়াচ্ছেন বাইরের ইন্ধনেই। তাদের অধিকাংশই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে ভালোভাবে বাঁচতে চান।

এসপিজিআরসির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডির বেশিরভাগ মেন্স সেলুনে বিহারিরা সুনামের সঙ্গেই কাজ করছেন। নাগরিক পরিচয়পত্র থাকায় অনেকে নিজেরাই সেলুন দিয়ে বসছেন। কসাইরাও মূলধারায় মিশে যেতে পারছেন। কিছু ছেলে অন্য পেশা যেমন গ্যারেজে যানবাহন মেরামত কাজের সুযোগও পাচ্ছে; কিন্তু চাহিদার তুলনায় কাজের জোগান এখনো অনেক কম।

বিজরি মহল্লার খেলার মাঠের পাশের জেনেভা ক্যাম্পের ৭২ বছর বয়সী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে আমরা এখন এদেশের নাগরিক হলেও কাজের সংকট প্রকট। কেউ সে সুযোগ না দেয়ায় মাদক ব্যবসা তরুণদের কাছে সহজ ও অধিক অর্থলাভের উপায় হয়ে গেছে।’ এসপিজিআরসির সদস্য ইকবাল হোসেন জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাদক কারবারের ভয়াবহরূপ আপনা থেকেই সামনে চলে আসাকে তারা বরং ভালোই মনে করছেন।

তিনি বলেন, আগে মাদক থেকে পরিত্রাণ দরকার। সঙ্গে প্রয়োজন তরুণদের নতুন পেশায় নিয়ে আসা। আর মাদকের সহজ কিন্তু ভয়াবহ রাস্তা খোলা না রাখাই হবে পূর্বশর্ত। ইকবাল জানান, তারা (আহ্বাবায়ক কমিটি) গত ২৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্যাম্পের ভেতরে কী কী অসুবিধা, কী কী চাহিদা, সংঘর্ষের কারণ, ক্যাম্পে কারা সংঘর্ষ করছেন এবং কারা মাদক ব্যবসা করছে সেগুলো জানিয়ে প্রতিকারের আশায় স্মারকলিপিও দিয়েছেন। মিরপুর ১০ এবং ১১-এর ক্যাম্পগুলো পরিচালনা করে ক্লাব নামে পরিচিত এনএলআরসি এবং এসপিজিআরসি।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস্ রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার জানান, ২০০১ এবং ২০০৭ সালের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ এবং ২০০৮ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পান উর্দুভাষীরা। তবে এই স্বীকৃতির ১৬ বছর পরেও তাদের মর্যাদার সঙ্গে স্থায়ী পুনর্বাসন করা হয়নি। এ কারণেই তাদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

এদেশেই থাকতে চান তারা
মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর বিহারি ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে জানা গেছে, পঞ্চাশোর্ধ্ব বিহারিরা এখনো অনিশ্চয়তার সুরে পাকিস্তানে ফিরে যাবার কথা বললেও চল্লিশের নিচে যারা, তারা এদেশেই থাকতে চান। তারা উর্দুর পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবে বাংলায়ও কথা বলেন। জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠা, বন্ধু-বান্ধব সবই এদেশে। তাই নাগরিকত্ব পেয়ে আর পাকিস্তানে ফেরত যেতে চান না তারা। জেনেভা ক্যাম্পের বিহারিদের আইনি সহায়তা দেয়া অ্যাডভোকেট বিউটি আক্তার জানান, তরুণরা এখন এ দেশেই থাকতে চান। আগে বিহারিদের মধ্যে নিজেদের মধ্যেই বিয়ের রীতি ছিল। এখন তারা বাঙালিদেরও বিয়ে করছেন।

মিরপুর ক্যাম্পের বাসিন্দারা দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুরের নারীদের বেশি বিয়ে করছেন। ক্যাম্প লাগোয়া মিরপুরে এই জেলাগুলোর লোক বেশি। আর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা জানান, তারা ময়মনসিংহ এবং এর আশপাশ এলাকার মেয়েদের বেশি বিয়ে করছেন। ওই এলাকার মেয়েরা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এমনি এক পরিবারের ছেলে মো. নাদিম। বাবার কাছে সেলুনের কাজ শিখে কাজ করছেন মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এবং আদাবরে। নাদিম জানান, মা বাঙালি হওয়ায় বাংলাভাষীদের সঙ্গে মেশা অনেক সহজ হচ্ছে।

সন্তানদের ভালো ভবিষ্যৎ দিতে তার বাসার আশপাশে অন্তত ১০টি পরিবার বিয়ের পরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে। তাদের বেশিরভাগেরই বাঙালি সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলেও জানান নাদিম। নাদিম বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছি। কাজের সুযোগও আসছে। এখন শুধু চাই, কাজ শেষে বিহারি বলে দূরে যেন ঠেলে না দেয়া হয়। সবার সঙ্গে বাঙালিদের মতো করেই যেন মিশতে পারি।’ উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান আল ফালাহ বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ বলেন, অনেক বিহারি সন্তান এখন বাংলা স্কুল বা কলেজে পড়ছে। তাদের মাধ্যমেও বিহারিদের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আসছে, যা তাদের নতুন পেশায় নিয়ে আসতে এবং বাংলাদেশ চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে উঠতে সাহায্য করছে।’

মিরপুর ওয়াপদা ক্যাম্পের বাসিন্দা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ ইয়াসিন বলেন, ‘আমরা এই দেশের নাগরিকত্ব পেলেও সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হয়নি। আমরা দেশের একমাত্র ভাষা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়; কিন্তু আমাদের বিষয়ে সংবিধানে কিছুই বলা নেই।’ ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, পিছিয়েপড়া জাতিগোষ্ঠীর মতোই বিশেষত নিজ ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ অন্তত আমাদের দেয়া হয়। যেন বাংলাদেশি চেতনা ধারণ করে দেশ নির্মাণে আমরাও অংশ নিতে পারি’ বলে জানান তিনি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ