রক্তে ভেজা প্রেমের চিঠিতে রানা প্লাজার স্মৃতি
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা শুধু তোমার জন্য।’ প্রেমিকা আশা চিঠিটা লিখেছিলেন তার প্রেমিক আল-আমিনকে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে নিহত হন আল-আমিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, আল-আমিনের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর তার পকেটের মানি ব্যাগে পাওয়া যায় ভালোবাসার এই চিঠি। দুর্ঘটনার সেই দিন আল-আমিনের রক্তে ভিজেছিল ভালোবাসার আকুতি। আজ রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর। এতদিনে আশাও হয়তো ঘর করছে অন্য কারও। সাদা চোখে সবকিছুকে অনেকটা স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। তবে কুকড়ে যাওয়া কাগজে জ্বলজ্বল করে ভেসে থাকা লেখাটি বলছে ভিন্ন কথা। এখনো হয়তো আশা নিজের মতো করে মনে করেন আল-আমিনকে। ২৪ এপ্রিল, রানা প্লাজা ধসের দিন এলেই অন্যদের মতো তারও হয়তো প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বুক ভারী হয়ে আসে। হয় দীর্ঘশ্বাস। তবে সে ব্যথার কথা আর বলা হয়ে ওঠে না কাউকে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছর উপলক্ষে সাভারে আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে এই চিঠিটি প্রদর্শিত হয়। এরপরেই আশার কিংবা আল-আমিনের পরিবারের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’। কথা হয় চিঠিটির সংগ্রাহক বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সালটা হয়তো ২০১৩-এর শেষ কিংবা ২০১৪-এর শুরু। জয়পুরহাট জেলার যেসব শ্রমিক রানা প্লাজায় নিহত ও আহত হয়েছিলেন তাদের খোঁজ খবর নিতে সেখানে গিয়েছিলেন তারা। সেসময়ই তাদের কথা হয় আল-আমিনের পরিবারের সঙ্গে। ওই দিনই আল-আমিনের মা তাদের হাতে মানিব্যাগ ও চিঠিটা তুলে দেন ও সংগ্রহে রাখার অনুরোধ জানান।’
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নিয়ে তাদের শ্রমিক সংগঠনের সংকলন ‘হাজার প্রাণের চিৎকার’ এর বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আল-আমিনের মা আনোয়ারা তাদের জানিয়েছিলেন, অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতেই আল-আমিন ও শাহিন রেজা দুই ভাইকে শহরে পাঠায় তাদের পরিবার। দুই ভাই একসঙ্গে রানা প্লাজায় গড়ে ওঠা কারখানায় কাজ করতেন। ভবন ধসে দুই ভাই মারা যান। আল-আমিনের লাশ পাওয়া গেলেও, মেলেনি শাহিন রেজার মরদেহ।’
তবে আশার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছিল কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তাসলিমা আখতার বলেন, ‘আশার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। আল-আমিনের পরিবারের বর্তমান অবস্থাও জানা নেই। তবে রানা প্লাজার বিষয়টি সামনে আসলেই চিঠিটা ব্যথিত করে। তাই এই দুর্ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’
শুধু আল-আমিন কিংবা আশা নয়। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে স্বজন কিংবা প্রিয়জন হারানো এমন অনেকের সঙ্গে কথা হয় ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর। ছেলে ফজলে রাব্বিকে হারিয়ে এখনো দিশেহারা মা রাহেলা বেগম। পরিবারের বড় ছেলের মৃত্যুতে কীভাবে পুরো পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে সে কথা জানাচ্ছিলেন তিনি।
রানা প্লাজা ধসের ১৮ দিন পরে সন্তান শাহিদা আক্তারের লাশ ফিরে পেয়েছিলেন মা তাহেরা বেগম। বয়সের ভারে এখন ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না তিনি। তবে এখনো ভাবেন এই বুঝি ফিরে এলো শাহিদা। শুধু ক্ষতিপূরণের নামে কিছু অর্থই যে প্রিয়জনের অভাব পূরণ করতে পারে না সেকথা বলছিলেন তারা। তাদের এই মর্মান্তিক বিপর্যয়ের জন্য যারা দায়ী তাদের সর্বোচ্চ শাস্তিও দাবি করেন রাহেলা কিংবা তাহেরার মতো আরও অনেকে।
এদিকে যে কোনো বিপর্যয়ের ভয়াবহ প্রভাব রাষ্ট্রকে আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন সমাজ বিজ্ঞানী ও ইউনিভার্সিটি অব ইস্টার্ণ-ফিনল্যান্ডের ফ্যাকাল্টি শহীদ মল্লিক। তিনি বলেন, ‘যে কোনো বিপর্যেরই প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হয়। আর সেটা যদি অবহেলায় হাজারো মানুষের জীবন নাশের মতো ঘটনা হয়, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব পরিবার, পরিজন কিংবা সমাজকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। ফলে এর দায় রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই কাঠামোগত এসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এখনই যদি রাষ্ট্র যথাযথ পদক্ষেপ না নেয় তবে বারবার এমন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে