ডিসেম্বরেই নির্বাচনের লক্ষ্যে অটল বিএনপি
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যম ও মাঠ পর্যায়ের নেতাদের মাঝে চলমান বাস্তবতায় নির্বাচন, সংস্কার এবং বিচার নিয়ে সংশয় থাকলেও দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্বাচনকেন্দ্রিক দাবি এবং তা আদায়ে সক্রিয় থাকার কথা জানিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৯ মাসে দুটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে ছয় উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি উঠলেও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের দাবি ওঠা তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাও শোনা যায়নি।
এ সত্ত্বেও গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) আকস্মিকভাবে গুঞ্জন ওঠে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে চাইছেন। কারণ হিসেবে সামনে আসে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের চাপ, সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য, মব সন্ত্রাস, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর বিতর্ক এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা বিদেশিদের হাতে দেয়ার পরিকল্পনার মতো ইস্যুগুলোও। অভিমান থেকে হোক আর নানামুখী চাপ থেকেই হোক অধ্যাপক ড. ইউনূসের পদত্যাগের ইস্যুতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়। তবে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ২৪ মে প্রথমে বিএনপি, এরপরে জামায়াতে ইসলামী এবং ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে সরকারি বাসভবন ‘যমুনা’য় বৈঠকে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। পরদিন এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, ইসলাম আন্দোলনসহ ২০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বিগত নয় মাস ধরে নানা ইস্যুতে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীতে আন্দোলন হচ্ছে। রাজপথ বন্ধ করে এসব আন্দোলনের কারণে নগরজুড়ে যানজট, জনভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। গত এক সপ্তাহে বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠন ও অনুসারীদের আন্দোলনে ঢাকা রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়ে। আর তাই বৈঠকের সংবাদ দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্বস্তির হওয়া নিয়ে আসে; কিন্তু এরই মাঝে বিএনপির নির্বাচনের রোডম্যাপ এর জন্য তাড়াহুড়ো এবং অপরপক্ষে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সংস্কার এবং আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের সহযোগীদের বিচারের দাবিতে অনড় অবস্থান পরিস্থিতিকে শান্ত হতে দিচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিএনপির বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কমিটি এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপি নির্বাচন নিয়ে যে অবস্থান নিয়েছে তা তারা সমর্থন করে এবং দলীয় আদেশে রাজপথে আন্দোলনের জন্যও তারা তৈরি। তবে জনগণের সার্বিক চিন্তাভাবনা উপলব্ধি করে বিএনপি সাম্প্রতিক বক্তব্য জনগণের ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে কি না সে বিষয়েও তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জনের পরে দাবি-দাওয়া এবং মতামত প্রকাশে আরো কৌশলী হওয়ার কথা বলছেন তারা।
একই সঙ্গে তারা বলছেন, নির্বাচন প্রধান লক্ষ্য হলেও অধ্যাপক ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা পদে রাখার যেমন বিকল্প নেই তেমনি নির্বাচনের পূর্বে ন্যূনতম সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া আরো দৃশ্যমান হওয়া দরকার। যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘যদিও বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা (সালাহউদ্দিন আহমেদ) বলেছেন- প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে জনগণ নতুন বিকল্প খুঁজে নেবে; কিন্তু বাস্তবতা হলো তেমন গ্রহণযোগ্য বিকল্পেরই এখন স্বল্পতা আছে। তাই অনেকেই এই ভাবনার বিরোধিতাও করেছেন।’
কেন্দ্রীয় কমিটির আরও এক নেতা বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে বিএনপির মাঝে দ্বিধা আছে বরং তাকে রেখেই ডিসেম্বরে নির্বাচন আদায়ে সচেষ্ট হতে বেশি আগ্রহী। প্রয়োজনে আরও কিছু সময় দেবার কথাও আলোচনা হচ্ছে।’ যুবদল এক নেতা বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে সকল নেতাকর্মীরাই নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। তবে তাদের মধ্য থেকেও বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং সংস্কার নিয়ে নানা প্রশ্ন কিন্তু উঠে আসে। তবে আমরা একটি বিষয়ে একমত যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না পারে তবে নির্বাচন দিয়ে দিক। বিএনপি সরকারে গেলে সংস্কার এবং বিচারের গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা করবে।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘নির্বাচনের পূর্বেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন, তবে তারা সংস্কার শুরু করে দিতে পারেন। যা বিএনপি সরকারে গেলে কার্যকরভাবে সম্পাদন করবে; কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি তারা দেখাতে পারেননি।’
দলীয় সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা একতাবদ্ধ। তাই এমন কোন বিষয়ই ঘটেনি। আমরা বরাবরই বলে আসছি সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের কাজ চলতেই পারে। আর সব গুছিয়ে নিতে ডিসেম্বরের বেশি কোনোভাবে লাগার কথাই না। তাই আমাদের মাঝে দ্বিধা নেই। আমরা জানি দেশের প্রয়োজনে এখন দরকার গণতান্ত্রিক সরকার এবং আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি।’
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে স্থায়ী কমিটির সভা শেষে স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরই উপযুক্ত সময় কারণ এর পরে রোজা চলে আসবে, তারপরে বর্ষা চলে আসবে, তারপরে এসএসসি-এইচএসসির মতো বড় বড় পাবলিক পরীক্ষা আছে। তাই এই মাসগুলো কিন্তু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় না। অতীতে যত নির্বাচন হয়েছে; কেবল একটি নির্বাচন বাধ্যবাধকতা থাকাতে জুন মাসে হয়েছিল। এ ছাড়া নির্বাচনই ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি এই সময়টাতেই হয়েছে।’
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যে রাজনৈতিক দল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হবে, তার কোনো ফিউচার নেই। আগামীর রাজনীতি আগের রাজনীতির মতো হবে না। আগামী রাজনীতি সত্যিকার অর্থে পরিবর্তনশীল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য করতে হবে। যে সমস্ত রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দল এটা বুঝবে না, তাদের কোনো রাজনৈতিক ফিউচার নেই। যে পরিবর্তনের আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্য মানুষ অপেক্ষা করছে, সেটা যদি আগামী রাজনীতি দিতে না পারে, সে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলের কোনো ফিউচার আছে বলে আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘এক হাজার সংস্কার করে বাংলাদেশে কোনো লাভ হবে না। যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হয়। সংস্কারের প্রথম ধাপ হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। এটা অব্যাহত রাখতে হবে।’ সংস্কার নিয়ে তিনি বলেন, ‘সংস্কারের ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত দেখছি না। সংস্কার করে ওরা (অন্তর্বর্তীকালীন) গলা শুকিয়ে ফেলেছে। সকলে সংস্কারপত্র অলরেডি জমা দিয়েছি। ড. ইউনূস প্রথম থেকে বলছেন, যেখানে ঐকমত্য হবে, সে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। সংস্কারপত্র সকলে জমা দেয়ার পরও কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, এ বিষয়গুলো জাতিকে জানানো হচ্ছে না কেন। এটা তো একটা রহস্যের ব্যাপার।’
বিচারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিচারের কথা যেখানে বলছে, বাংলাদেশে এমন কোনো লোক নেই যারা আওয়ামী লীগের বিচার চায় না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। আমাদের চেয়ে বেশি বিচার চায় অন্য কোনো দল তো হবে না। আমাদের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ হয়নি। সুতরাং বিএনপি তো বিচারের জন্য বেশি আগ্রহী। সরকারের কাজ হচ্ছে বিচারের আওতায় আনা। বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে এদের বিচার করতে হবে। তাহলে ১০ মাসে সরকার এদেরকে বিচারের আওতায় আনতে পারছে না কেন। সরকার যদি তাদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়, আমরা তো তাদের বিচারের আওতায় আনব; কিন্তু বিচার করবে স্বাধীন বিচার বিভাগ, সরকার করবে না। আমরা শেখ হাসিনার মতো বিচার করে, বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না।’
অনুষ্ঠান শেষে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ‘ভিউজ বাংলাদেশ’কে বলেন, ‘বিএনপির মাঝে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন দ্বিধা বা সংশয় নেই। দেশের সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প নেই। আর তাই আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনের কথাই বলছি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে