শুভ নববর্ষ ১৪৩১
বাঙালির শেকড় আর ঐতিহ্যের টানে বৈশাখ পেয়েছে নতুন মাত্রা
বাঙালি জাতির সর্বজনীন উৎসবের প্রধান উপলক্ষ পহেলা বৈশাখ। পুরোনোকে ভুলে শুদ্ধতার স্রোতে অবগাহনের দিন। এদিনের নতুন সূর্যের সঙ্গে বাঙালির পথে প্রান্তরে শুরু হয় এক উৎসব আবহ। ফসলকেন্দ্রিক নানা হিসাব-নিকাষ, হালখাতা, নানা রকমের মেলা, নগরে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা সবকিছু মিলে বাঙালি জাতির জীবনে এটি একটি রঙিন দিন। যে দিন নতুনের বারতা নিয়ে পুরোনোকে ভুলে সামনে চলার শপথ নেন বাঙালিরা।
কিছুটা অস্পষ্টতা আর বিতর্ক থাকলেও সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক বলা হয়। আকবরের শাসনামলের প্রথম দিকে মুঘল সাম্রাজ্যে হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো; কিন্তু সেই দিনপঞ্জিতে ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তিনি তার নবরত্নের একজন, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির নির্দেশ দেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সিরাজী ১৫৮৫ সালে বাংলা সৌরবর্ষভিত্তিক একটি দিনপঞ্জি তৈরি করেন। সম্রাট আকবর এই দিনপঞ্জি মেনে নেন এবং তার সিংহাসনের আহোরণের দিন অর্থাৎ ১৫৫৬ সাল থেকে কার্যকর করার ফরমান জারি করেন। ফলে বাংলা প্রথম বঙ্গাব্দ হয় খ্রিষ্টীয় ১৫৫৬ সাল।
ঐতিহাসিকরা আরও উল্লেখ করেছেন, বিশাল ভারতবর্ষে সম্রাট আকবরের সময়ই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছিল। আর তাই তিনি বিভিন্ন সংস্কার কাজ শুরু করতে পেরেছিলেন। যার অংশ হিসেবেই আকবর সন বা সাল সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে ভূমি জরিপ শুরু করেছিলেন। আর এ কাজ করতে গিয়েই খাজনা আদায়ে সমস্যার বিষয়টি সামনে চলে আসে। সে সময় খাজনা আদায় করা হতো চন্দ্র সন (হিজরি ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী। আর চন্দ্রসনে প্রতি বছর ১০-১১ দিন পিছিয়ে যেত। তিন বছরে এক মাস পিছিয়ে যেত। আর ৩২-৩৫ বছরে বাড়তি একটি বছর বেড়ে যেত। আর এসব কারণেই সে সময় সারা বিশ্বের পণ্ডিতরা হিজরি সনের বিরুদ্ধে তাদের মতামত তুলে ধরেন। দিল্লির শাসকরাও এসব কথা জানতেন। এটা পরিবর্তনের পক্ষে তাদের মতও ছিল, যা শুরু করেন সম্রাট আকবর। ফতেহউল্লাহ সিরাজী সম্ভবত হিজরি সনের কাঠামো বজায় রেখেই বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তবে মূল পরিবর্তন হয়, চান্দ্র সন থেকে পরিবর্তিত হয়ে বছর গণনা শুরু হয় সূর্যকেন্দ্রিক। খাজনা আদায় আর ফসল ফলানোর সঙ্গে বিষয়টি জড়িত ছিল বলেই সে সময় এই সনকে ফসলি সনও বলা হতো। আর যেহেতু বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সূর্যভিত্তিক মাস গণনা পদ্ধতি অনেক আগে প্রচলিত ছিল সেহেতু এই নতুন পদ্ধতিটি বাঙালিরা সহজে গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে দীর্ঘকাল অতিক্রম করে এই সালটি বাঙালির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যে উৎসবের আবহ, তা এক দিনে আসেনি। এর সঙ্গে হালখাতা আর পুণ্যাহর সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়; কিন্তু এই হালখাতা বা পুণ্যাহ সব জায়গায় কৃষকদের কাছে খুব একটা আনন্দের উপলক্ষ ছিল না। কারণ এ দিন তাদের জমিদার বা মহাজনের পাওনা পরিশোধ করতে হতো; কিন্তু তারপরও এই দুই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আনন্দের উপকরণ ছিল। মিষ্টি, মিঠাই খাওয়ানোসহ এই দুই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আনন্দ আয়োজন রাখা হতো। এ ছাড়া মেলার প্রচলন সেই প্রাচীন কাল থেকেই ছিল। নতুন বছরকে ঘিরে এই মেলার আনুষ্ঠানিকতাও ভিন্ন মাত্রা পায়। আর মুঘল আমলে নওরোজ (ফারসি নতুন বছর বরণের উৎসব) উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হতো। তবে এই উৎসব ছিল শুধু সমাজের উঁচু শ্রেণির জন্য। এ উৎসব ঘিরেই মিনা বাজারের প্রচলন হয়েছিল। রাজপ্রসাদের এই উৎসবে জাঁকজমক থাকলেও এখানে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। কৃষক আর জন সাধারণের উৎসব উপলক্ষ ছিল মেলা, হালখাতা, পুণ্যাহসহ অন্যান্য উৎসব।
পহেলা বৈশাখ ঘিরে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পরপরই পাঞ্জাবি প্রশাসন নানাভাবে বাঙালিদের নিগৃহীত করতে থাকে। চালায় উর্দু আগ্রাসন। চেষ্টা চলে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের। এই সময় বাঙালিরা আরও গভীরভাবে তাদের শিকড়ের টান অনুভব করে। শুরু হয় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালনের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সরকারিভাবে প্রথম পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ১৯৫৪ সালে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রথম পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন; কিন্তু তারপর সামরিক শাসন জারিসহ পাক প্রশাসনের আগ্রাসী নীতির কারণে সরকারিভাবে আর পহেলা বৈশাখ পালিত হয়নি।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে নতুন করে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে। ১৯৬১ সালে রবি ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে পাক সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এ ছাড়া পাঞ্জাবিরা ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথের গানকে রীতিমতো বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করতে থাকে। এমনই বাস্তবতায় সামনে এগিয়ে আসে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। শুরু হয় অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে পহেলা বৈশাখে গানের অনুষ্ঠান আয়োজন। বৈশাখে ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান হয় বলধা গার্ডেনে। এরপর তা স্থানান্তুরিত হয় রমনার বটমূলে। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, কামাল লোহানী, ফরিদা হাসান আর সবার ওপরে ছায়ার মতো ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন খালাম্মা কবি বেগম সুফিয়া কামাল।
রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রথম বর্ষবরণের গানের অনুষ্ঠান হয় ১৯৬৭ সালে। সে সময় অশ্বত্থ (যাকে আমরা বট গাছ বলে থাকি) গাছ থেকে শুয়ো পোকা ঝরে পড়ত। অনেক জঙ্গলে ঘেরা সেই জায়গায় তেমন মানুষ চলাচল করত না। তবে সেই অনুষ্ঠানে ছিল মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ। সামরিক শাসকদের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার অনাবিল আনন্দ। সেই সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হতো সকাল ৬টায়। যে ঐতিহ্য আজও বজায় রেখেছে ছায়ানট। সে দিনের সেই শুরু বাঙালি জাতির জীবনে নতুন দিনের সূচনা করে। বর্তমান ছায়ানটের প্রধান আর সেই দিনের সেই শুরু সারথি সন্জীদা খাতুন এক নিবন্ধে লিখেছেন, নববর্ষের কান্ত প্রভাত আমাদের মুক্তিকামী করেছিল, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালির রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার পথে।
স্বাধীনতার পর নব উদ্যোমে নতুন করে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন থেকেই বৈশাখ সরকারি ছুটি। বাঙালির উৎসব আর আনন্দের দিন। তবে এ যাত্রাও খুব সহজ ছিল না। সামরিক শাসক আর নানা সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার ছায়ানটের অনুষ্ঠান আর বৈশাখ আয়োজনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে; কিন্তু তারা সফল হয়নি। মানুষের আবেগ আর ভালোবাসায় পরাজিত হয়েছে অশুভ শক্তি। রক্ষা পেয়েছে সাংস্কৃতিক অধিকার আর স্বাধীনতা। তবে পহেলা বৈশাখ অনেক সময় মানুষের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদের অপশাসনের প্রতিবাদে চারুকলা থেকে বের করা শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা এখন পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ।
যুগে যুগে বৈশাখ উদযাপনের ওপর বাধা এসেছে। ১৯৯৯ সালে বোমা হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটেছে; কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি এই উৎসব। কোনোভাবেই বন্ধ হয়নি এর বিস্তার। বরং বাঙালির শেকড় আর ঐতিহ্যের টানে বৈশাখ পেয়েছে নতুন মাত্রা। পরিণত দেশের বৃহৎ সর্বজনীন উৎসবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে