বইয়ের ব্যবসা আহামরি কোনো ব্যবসা না, তবে সম্মানজনক ব্যবসা
বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জিনিয়াস পাবলিকেশন্স। বিশেষত রাজনৈতিক বই প্রকাশ করেই প্রকাশনা সংস্থাটি সচেতন পাঠকের দৃষ্টি কেড়েছে। প্রকাশনীটির গবেষণামূলক ও সৃজনশীল বইয়ের সম্ভারও বিশাল। বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিক বইগুলো জিনিয়াস পাবলিকেশন্স পুনঃমুদ্রণ করে থাকে। বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত সব রচনারও অনুবাদ প্রকাশ করে। আছে ছোটদের জন্য প্রকাশনা। সব মিলিয়ে সব ধরনের পাঠককেই আকৃষ্ট করতে চায় প্রকাশনা সংস্থাটি। বইমেলায় জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের প্যাভিলিয়নে সব সময় ভিড় লেগেই থাকে। বইমেলা উপলক্ষে জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সম্পাদক কামরুল আহসানের।
ভিউজ বাংলাদেশ: ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনি কেমন আছেন?
হাবিবুর রহমান: জ্বি, ভালো আছি। বইমেলার মাস। এ সময় আমরা একটু বেশি ভালো থাকি। লেখক-পাঠক-প্রকাশকের এক মিলনমেলা। লোকজন আসছে, ঘুরছে, আড্ডা দিচ্ছে। সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। দেখতেই ভালো লাগে।
ভিউজ বাংলাদেশ: চাপ বোধ করেন না? প্রত্যাশা অনুযায়ী যদি বই বিক্রি না হয়?
হাবিবুর রহমান: আমি কোনো চাপ বোধ করি না। জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের বই সারা বছর ধরেই বিক্রি হয়। বইমেলাটা আমার কাছে মূলত আনন্দেরই একটা জায়গা।
ভিউজ বাংলাদেশ: আচ্ছা। খুব ভালো। এবার জিনিয়াস থেকে মোট কতগুলো বই আসছে।
হাবিবুর রহমান: মোট ২৫টার মতো বই প্রকাশ হয়েছে। আরও কিছু আসতে পারে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আচ্ছা, আমরা জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের শুরুর কথা একটু শুনতে চাই। কীভাবে এই প্রকাশনীর যাত্রা শুরু হলো?
হাবিবুর রহমান: জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের বয়স দুই যুগ। মূলত এটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। প্রথমে দাদার ছিল। পরে বাবার ছিল। ওটা এখনো অন্য নামে আছে। পরে আমি ২০০১ সালে আলাদা প্রকাশনা সংস্থা করি। নাম দেই জিনিয়াস পাবলিকেশন্স।
ভিউজ বাংলাদেশ: জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের বয়স প্রায় ২৫ বছর। এই ২৫ বছরে জিনিয়াস পাবলিকেশন্স থেকে মোট কতগুলো বই বেরিয়েছে?
হাবিবুর রহমান: হাজারের ওপরে। জিনিয়াস পাবলিকেশন্স কিন্তু শুধু মেলা উপলক্ষে বই করে না। সারা বছর ধরেই কিছু কিছু বই প্রকাশ করে থাকে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাদের বহু বিচিত্ররকম প্রকাশনা। ক্ল্যাসিক সৃজনশীল, মননশীল, গবেষণামূলক, অনুবাদ, ছোটদের বই। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে আপনাদের প্রচুর বই। আপনাদের মূল ফোকাসটা আসলে কোন দিকে?
হাবিবুর রহমান: আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। আমাদের স্লোগান হলো- ‘চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রকাশ করতেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর বই প্রকাশ করেছি। পাশাপাশি সৃজনশীল ও অনুবাদ বইয়ের দিকেও আমাদের নজর আছে। কারণ, সব ধরনের পাঠককেই আমরা আকৃষ্ট করতে চাই। সে জন্য ছোটদের বইও আমরা অনেক প্রকাশ করি।
ভিউজ বাংলাদেশ: বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলোতে দেখা যায় বেশির ভাগই কপি পেস্ট। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর বই বেরিয়েছে। সেগুলোর বেশির ভাগেরই নতুন কোনো গবেষণা নেই। অনেক ক্ষেত্রে সুসম্পাদিতও না। সেগুলো আপনারা কীভাবে পরিচালনা করেন এবং এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
হাবিবুর রহমান: আসলে এটা হচ্ছে যার যার মানসিকতা, কে কী রকম বই করবে। ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকে অসাধুতার আশ্রয় নেয়। তারা নিজেদের নামের দিকেও তাকায় না, মানেরও দিকেও তাকায় না; কিন্তু জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের তো আলাদা একটা নাম আছে। প্রকাশনা একটা একটা সাধনার ব্যাপার, গবেষণার ব্যাপার। আমি মনে করি একজন প্রকাশকেরও গবেষক হওয়া দরকার। ব্ঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই করতে হলে একজন প্রকাশককে গবেষণা করতে হবে। পাণ্ডুলিপি পেলেই ছাপিয়ে দিলে তো হবে না। এটা যাচাই-বাছাই করতে হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি বলছেন একটা সম্পাদনা বিভাগের কথা। জিনিয়াসের কি নিজস্ব সম্পাদনা বিভাগ আছে?
হাবিবুর রহমান: অবশ্যই। বিশাল বড় এক সম্পাদনা বিভাগ আছে। শুধু তাই নয়, সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনো বই হলে আমি সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দেখিয়ে নেই। আমি নিজে সব শেষে দেখি। কোনো সন্দেহ-সংশয় থাকলে আবার যাচাই করে নিই।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ‘ভায়েরা আমার’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন। এই বইটি সম্পর্কে কিছু বলুন।
হাবিবুর রহমান: ‘ভায়েরা আমার’ আমাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। প্রকাশের পর থেকেই বইটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। অনেক গবেষক লেখক-আলোচক নিজের প্রয়োজনেই বইটি পড়ছেন। এটি তো একটি দলিল। জাতির ইতিহাস এর সঙ্গে যুক্ত। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যত ভাষণ দিয়েছেন তার সবেই এখানে সংকলিত আছে। মোট ২০০টি ভাষণ এখানে গ্রথিত হয়েছে। অনেক ভাষণ বাংলাদেশ বেতারে সংরক্ষিত টেপ থেকে শ্রুতিলিখন করা হয়েছে। আর কোনো বইতে এই ভাষণগুলো নেই। তাই এটি জাতির একটি সম্পদও। ভাষণগুলোর সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন নজরুল ইসলাম স্যার। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ-রাইটার। বইয়ের নাম রেখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। ভূমিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থা থেকেই বক্তৃতা করতেন। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। কথায় কথায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৫৫ সালের আগের কোনো ভাষণ পাওয়া যায়নি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনারা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও কিছু বই প্রকাশ করেছেন।
হাবিবুর রহমান: হ্যাঁ, ‘মুজিব বাংলার বাংলা মুজিবের’। এটিও আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নিজের জীবন, পরিবার, স্বপ্ন, দেশ নিয়ে লিখেছেন এই বইতে। তিনি কী করতে চান, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে কীভাবে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চান সেই স্বপ্নের কথাই তিনি তুলে ধরেছেন বইটিতে। বঙ্গবন্ধু যেসব স্বপ্ন দেখেছেন তিনি সেই স্বপ্নগুলোই দেখেন। আরও বেশি দেখেন। তার স্বপ্নের রূপই আজকের বাংলাদেশ। তারপর আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচিত ১০০ ভাষণ প্রকাশ করেছি। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী যত ভাষণ দিয়েছে তার থেকে ১০০ ভাষণ বাছাই করে সংকলনটি প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর আরও ভাষণ প্রকাশ করব। আরেকটা বই আসছে ‘জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ’। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যত ভাষণ দিয়েছেন তার একটি সংকলন। আরেকটা বই প্রকাশ হবে, ‘জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ’।
ভিউজ বাংলাদেশ: এ-ধরনের সরকারি বই করতে আপনারা কোনো প্রশাসনিক চাপ বোধ করেন?
হাবিবুর রহমান: না, প্রশাসন তো আমাদের সহযোগিতা করে। এসব তথ্যবহুল বই করা অনেক স্পর্শকাতর। একটু ভুল থাকলেই বিপদ। প্রশাসন আমাদের আন্তরিকভাবে অনেক সহযোগিতা করেছে। পরে আমাদের কাজ দেখে প্রশংসাও করেছে। আর আমাদের প্রকাশনা থেকে এ পর্যন্ত যত কাজ করেছি চেষ্টা করেছি অথেনটিক থাকতে। ভুলত্রুটি তো থাকেই। কাজ করলেই ভুল হবে না। কাজ না করলে ভুল হবে না। কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই, তাৎক্ষণিকভাবে এটা সংশোধন করার চেষ্টা করি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সাধারণ পাঠক বইমেলায় এসে কি প্রধানমন্ত্রী বা বঙ্গবন্ধুর বই কিনছে?
হাবিবুর রহমান: কিনছে। যার যার প্রয়োজনমতো সে সে বই কিনে। বইয়ের সঙ্গে একটা চেতনাযুক্ত। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তারা এসব বই কিনছে; কিন্তু, আমি মনে করি এ ধরনের বই আরও চলা উচিত। বাবা-মায়ের উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বইগুলো ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের পড়াতে অভ্যাস করানো।
ভিউজ বাংলাদেশ: ক্ল্যাসিক বইয়ের পুনঃমুদ্রণ, অনূদিত বইয়ের চেয়ে আপনাদের প্রকাশনীতে সমসাময়িক লেখকদের বইয়ের অভাব দেখছি, এটা কেন?
হাবিবুর রহমান: এর কারণ সমকালীন লেখকেরই তো অভাব। আমাদের তো ভালো লেখক পেতে হবে। পাণ্ডুলিপি তো অনেক জমা পড়ে; কিন্তু, সবই প্রকাশযোগ্য না। একটা বই কেন প্রকাশ করবে একজন প্রকাশক তাও তো ভাবতে হবে। বইটা হয় ব্যবসাসফল হতে হবে, না হয় বোদ্ধামহলের কিছু সুনাম আনবে। সেরকম পাণ্ডুলিপি তো পাওয়া যায় না।
ভিউজ বাংলাদেশ: বইয়ের মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে জিনিয়াস কী করে?
হাবিবুর রহমান: আমাদের নিজস্ব আউটলেট আছে। বিক্রিয় প্রতিনিধি আছে। সারা বছর ধরেই তারা বই বিক্রি করে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতেও এখন অনেক বই বিক্রি হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: সারা বছর ধরে আপনাদের যত বই বিক্রি হয়, আপনারা কি খুশি?
হাবিবুর রহমান: খুশি বলতে কি, প্রকাশনা কিন্তু শুধু একটা ব্যবসা না। এর সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। অর্থনৈতিকভাবে আমি যতটাই লাভবান হই, তার চেয়ে বেশি আমার আনন্দ এইখানে যে, আমার এই বই পড়ে তো সমাজগঠন হচ্ছে। তারপরও এটা যেহেতু একটা ব্যবসা, আমরা সীমিত লাভেই সন্তুষ্ট থাকি। বইয়ের ব্যবসা আহামরি কোনো ব্যবসা না, তবে, সম্মানজনক ব্যবসা।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কি মনে করেন জিনিয়াসের নিজস্ব কোনো পাঠকগোষ্ঠী আছে?
হাবিবুর রহমান: হ্যাঁ, আমি মনে করি জিনিয়াসের পাঠকগোষ্ঠী হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন তারাই জিনিয়াসের পাঠক। কোনো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জিনিয়াসের পাঠক হবে না।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য।
হাবিবুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ, ভিউজ বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে