বসন্ত আর প্রেমে মুখর বইমেলা
ছুটির দিন শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি)। স্বভাবতই এদিন বইমেলায় পাঠক ও দর্শনার্থীদের ভিড় চোখে পড়ে। তবে এবার এদিন একই সঙ্গে ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস হওয়ায় বইমেলা হয়ে উঠেছে লোকে-লোকারণ্য। সকাল থেকেই বইমেলায় প্রবেশমুখে ছিল বিশাল লাইন। দর্শনার্থীদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। তরুণদের পরনে লাল, নীল, সাদা বাহারি রঙের পাঞ্জাবি।
তরুণীদের পরনে বিভিন্ন রঙের শাড়ি, ব্লাউজ, রঙ-বেরঙের চুড়ি। খোঁপায় সাদা-লাল ফুলের মালা। হাতে ফুলের তোড়া, মাথায় ফুলের ব্যান, গলায় ফুলের মালা। তরুণ-তরুণীরা একে অপরের হাত ধরে হাঁটছেন, গল্পে মেতে উঠছেন আর ছবি তুলছেন। অনেকে অভিভাবকের হাত ধরে, বন্ধুরা মিলেও বইমেলার জনস্রোতে নিজেদের শামিল করেছেন।
শুধু বইমেলা নয়, শাহবাগের মোড় থেকে শুরু করে টিএসটি, ঢাবি চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ, হাকিম চত্বর, শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ সব অন্যরকম সাজে মুখরিত। নগরজুড়ে যেন শান্তি, কল্যাণ ও সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। বইমেলা ও এর আশপাশ এলাকা যেন প্রেমের জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। বলা যায়, সব মিলিয়ে আজ ভিন্ন এক পরিবেশ ছিল অমর একুশে বইমেলা।
বসন্ত ফাল্গুনের প্রথম দিন একইসঙ্গে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছিল বইমেলার চারপাশ। প্রকৃতিতেও অন্যরকম মিষ্টি আমেজ। গাছে গাছে ফুটেছে শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া। আমের বনে মুকুলের ঘ্রাণ। এসবে মুগ্ধ হয়ে হয়ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি/নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান!’
কয়েক বছর ধরে বসন্তের ‘মাতাল সমীরণে’ নতুন মাত্রা দিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা দিবস। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলা বর্ষপঞ্জির সংস্কার করার পর থেকে বাংলার বসন্ত আর ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ আসছে একই দিনে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সকাল থেকে শাহবাগের ফুল দোকানগুলোতে ছিল অন্যরকম ভিড়। বলা হয়ে থাকে, দেশে একদিনে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রিও হয় এই বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসে।
হৃদয়ে বসন্তের উষ্ণতা নিয়ে আজ বাইরে পা দিয়েছিলেন অনেকে। প্রিয়জনকে নিয়ে ভালোবাসার দিগন্ত ছুঁতে চেয়েছিলেন তারা। একটি দিন প্রিয় মানুষের সঙ্গে একান্তে নিজেদের মতো করে কাটিয়েছেন তারা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম দিনটিকে বেছে নেবে প্রিয় মানুষের কাছে একান্ত কিছু কথা বলার জন্য।
মোহাম্মদপুর থেকে পরিবার নিয়ে বইমেলায় এসেছিলেন আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘আজকে সত্যিই অন্যরকম একটি দিন। যে কারণে পরিবারসহ ঘুরতে বেরিয়েছি। বইমেলার ঘুরার আনন্দটাও অন্যরকম। আজকের বইমেলাটা একটু ভিন্ন রকম। প্রকৃতিও দারুণ। মানুষের ঢল নেমেছে আজকের বইমেলায়’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের একটি দল বিকেল চারটার দিকে মেলায় প্রবেশ করে। আজকের দিন সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের মধ্য থেকে শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম জানান, আজকের বিশেষ দিনে বন্ধু-বান্ধবরা মিলে বইমেলা এসেছি। মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে বইমেলায় ঘুরছি। আজকে প্রচুর পরিমাণে ভিড় বইমেলায়। অন্যান্য দিনগুলোতেও বইমেলায় এসেছি তবে আজকে বইমেলা একদম ব্যতিক্রম। বলতে গেলে মানুষের পা ফেলার জায়গা নেই। রঙিন পাঞ্জাবি, রঙিন শাড়ি আর মাথায় ফুল নিয়ে ঘুরছেন তরুণ-তরুণীরা’।
সময় প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী তিন্নি বলেন, ‘আজকে অনেক ভালো লাগছে। এ অনুভূতি প্রকাশের চেয়েও সুন্দর। কারণ আজকে ফাল্গুন। সবাই সেজেগুজে আসছেন। প্রায় সবার হাতে হাতে ফুল। আসলেই অন্যরকম লাগছে’।
‘বাংলা প্রকাশ’ প্রকাশনীর দায়িত্বে থাকা বিক্রয়কর্মী নাদিয়া জানান, ‘সকাল থেকে বইমেলায় দেখা যাচ্ছে যুগলরা আসছেন। কেউ কেউ হলুদ শাড়ি পরে আসছেন আবার কেউ কেউ ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ পালন করছেন। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই জমজমাট’।
রাজধানীতে বরাবরের মতো আজও বসন্ত উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ। বাসন্তী রং আর নাচে-গানে জমে উঠেছিল বসন্ত উৎসব। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে শুরু হয় এই আয়োজন। সমবেত বাদ্যযন্ত্র, বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। সকাল সাড়ে ১১টায় প্রাণ-প্রকৃতির গান, কবিতা আর ঐতিহ্যবাহী নাচ দিয়ে শেষ হয়েছে আয়োজনটি। অন্যান্য বছর এই আয়োজনটি রাত ৯টা পর্যন্ত চললেও এবার পবিত্র শবেবরাতের কারণে সংক্ষিপ্ত আয়োজনে উৎসব উদযাপন করা হবে।
প্রতি বছরের মতো এবারও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও উত্তরা দিয়াবাড়ীর লেকসংলগ্ন মাঠে বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।
অপরদিকে, বইমেলায় আজ নতুন বই এসেছে ২৫০টি। শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশুপ্রহর। অনুষ্ঠিত হয়েছে শিশ-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। সকাল ১০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অমর একুশে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন আবৃত্তি শিল্পী নাসিম আহমেদ, আবৃত্তিশিল্পী অনন্যা লাবণী পুতুল এবং অধ্যাপক ড. তারিক মনজুর।
এছাড়া বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আহমদ ছফার আগ্রহী যুবকেরা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তাহমিদাল জামি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নূরুল আনোয়ার ও সাজ্জাদ শরিফ। সভাপতিত্ব করেন সলিমুল্লাহ খান।
অনুষ্ঠানে প্রাবন্ধিক বলেন, ‘আহমদ ছফা ছিলেন একই সঙ্গে চিন্তা ও কর্মের কর্তা। তার আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল জ্ঞানগত, রাজনৈতিক ও বহুবিধ। ছফা রাজনৈতিক আকাঙ্খা বা রাজনৈতিক বাসনার লগ্নি ও বিলগ্নিকে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। সমাজের এক বা একাধিক শ্রেণি কিভাবে বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনে নিজের বাসনাকে স্থাপন বা লগ্নি করে, সে বিষয়টি ছফার চিন্তায় বারবার এসেছে। আবেগকে ছফা সমাজ রূপান্তরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে শনাক্ত করেছেন। এই আবেগ মানবিক ও সংস্কারকামী এবং একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক মেজাজের’।
সভাপতির বক্তব্যে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আহমদ ছফা অন্তদৃর্ষ্টি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি ছিলেন সৎ-সাহসী একজন মানুষ। তিনি নিজে যেমন লেখালেখি করেছেন, তেমনি অনেক লেখকও তৈরি করেছেন’। এ ছাড়াও লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি আসাদ কাজল।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি আসাদ কাজল, কবি হিজল জোবায়ের, কবি তাসনোভা তুশিন, কবি সুনৃত সুজন, কবি নাজমা আহমেদ এবং কবি মো. শফিক উল ইসলাম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ফেরদৌসী বেগম, ইশিতা জাহান অর্ণা, শিমুল পারভীন এবং আবীর বাঙালি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে