শেষ হলো বইমেলা,রয়ে গেল অনেক প্রশ্ন
অনেক বিষাদ, বিষণ্নতা আর বেদনা নিয়ে এবারের মতো শেষ হলো অমর একুশে বইমেলা। বই যারা ভালোবাসেন, বইমেলায় যারা নিয়মিত গিয়েছেন, বইমেলার দৈনন্দিন খোঁজ-খবর যারা রাখেন, বইয়ের সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট যারা- পাঠক, লেখক-প্রকাশক; তারা জানেন কেন এবারের বইমেলা এমন নিরানন্দ নিয়ে শেষ হলো! বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি, একটি প্রকাশনী বন্ধ করে দেয়া, একজন কবিকে নিষিদ্ধ করে দেয়া, বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করায় দুটি স্টল বন্ধ করে দেয়া ও নানা রাজনৈতিক জটিলতায় শুরু থেকেই এবারের বইমেলা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রচুর লোক সমাগম থাকলেও এবারের বইমেলায় বিক্রিবাট্টা হয়েছে অন্যান্য বইমেলা থেকে অনেক কম।
গতকাল শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এবার মেলার ব্যবস্থাপনায়, পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল। অনেক অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছে, তার একটা প্রভাব পড়েছে বিক্রিতে। মেলার বিক্রি নিয়ে হতাশ অধিকাংশ প্রকাশক। বিক্রি এতটা নেমে যাবে তারা ভাবতেই পারেননি। প্রকাশকরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় বিক্রি এক-তৃতীয়াংশের মতো।
এরকমটা হলে হতাশারই ব্যাপার। অন্যান্যবার মেলা শেষ হয়ে গেলে কবি-সাহিত্যিক-প্রকাশক-পাঠকদের চোখেমুখে একটা বিদায়ের বিষাদের ছায়া থাকলেও এবার বিষয়টি একেবারেই অন্যরকম। এবার সবার চোখেমুখে হতাশা। লেখক-প্রকাশকদের প্রশ্ন: কেন বই বিক্রি এতটা কমে গেল? এটা কি শুধু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে? না কি পাঠক বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন?
বাংলাদেশে বইয়ের পাঠক কমে যাচ্ছে এই আলোচনা গত কয়েক বছর ধরেই চলমান। মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে, বিনোদনের, সময় কাটানোর মাধ্যম বেড়েছে; এবং সর্বশেষ যে কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও বেড়েছে, তার সঙ্গে বেড়েছে বইয়ের মূল্যও; এত সব সামলে পাঠক আর বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বোধ করছেন না; কিন্তু পঠন-পাঠন একটা জাতির সাংস্কৃতিক অভ্যাসও। এটা স্বীকার করতেই হবে যে আমাদের বই পাঠের অভ্যাসটা সেভাবে কখনো ছিল না। তারপরও আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত একশ্রেণির পাঠক ছিলেন যারা অন্তত জনপ্রিয়ধারার বইপত্র পড়তেন, নিয়মিত পত্রিকা-ম্যাগাজিন পড়তেন, দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে নিয়মিত খবরাখবর রাখতেন।
এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, ফেসবুক। মোবাইলে-কম্পিউটারে বসে মানুষ ফেসবুকিং করে, রিল দেখে, ইউটিউবে যা খুশি তা-ই দেখে; ফলে বইয়ের প্রতি টান-ভালোবাসা কমে গেছে; কিন্তু এ-কথাও তো সত্য, একটা ভালো বই একজন মানুষকে যতটা সমৃদ্ধ করতে পারে আর কোনো মাধ্যম তা পারে না; এমন কি একটা ভালো চলচ্চিত্রও পারে না। কারণ বই মানুষের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে। তা ছাড়া বিষয়ভিত্তিক বইয়ে একটা নির্দিষ্ট চিন্তার পূর্ণাঙ্গ কাঠানো পাওয়া যায়। আর কোনো মাধ্যমে এভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।
তারপরও বইয়ের পাঠক কমে যাওয়াটা দুঃখজনক এবং বইয়ের পাঠক বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রেরও কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নেই; বরং অনেক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তারই ছাপ পড়েছে এবারের বইমেলায়। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের প্রকাশনা জগৎ হুমকির মধ্যে পড়বে। একটা ভালো বই প্রকাশের পেছনে একজন লেখকের যে শ্রম-সাধনা, তা যদি কোনোভাবে অবহেলার শিকার হয় তাহলে অনেক লেখক বই লিখতে ও প্রকাশ করতে নিরুৎসাহিত হবেন; যা শেষ পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্র-সমাজকেই অনেক পিছিয়ে দিবে। আমরা কোনোভাবে চাই না আমাদের বইমেলাটি এভাবে বিষণ্নতায়, হতাশায় রূপ নিক। জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি সমাজ-রাষ্ট্রকেই গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে আমাদের ধ্বংস কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে