স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো হোক
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান এবং শিক্ষার মতো চিকিৎসাও মানুষের মৌলিক অধিকার; কিন্তু আমাদের দেশে অন্য চারটি মৌলিক অধিকারের মতোই চিকিৎসাক্ষেত্রেও মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। বলা ভালো, আমাদের দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে সুচিকিৎসা পাওয়া থেকেই। একে তো পরিবেশে জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস, অনিয়মিত জীবনযাপনের কারণে এদেশের মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি অসুস্থ হয়, দ্বিতীয়ত, চিকিৎসাক্ষেত্রেও নানা অরাজকতা থাকার কারণে সঠিক চিকিৎসা পায় না। তারপরও, বলতে দ্বিধা নেই, সরকারেরও এ বিষয়ে যথেষ্ট অবহেলা আছে।
সোমবার (২০ মে) সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের দরিদ্র ২০ শতাংশ পরিবার মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি সুবিধার ২০ শতাংশও ভোগ করতে পারে না। ৪৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা খরচ মেটাতে কোনো না কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। দরিদ্র জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য সরকারের বরাদ্দও অপর্যাপ্ত। রোববার (১৯ মে) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি হলে আয়োজিত ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অধিকার প্রতিষ্ঠায় নাগরিক সমাজের অবস্থানপত্র শীর্ষক’ এক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এসডিজি অ্যাকশন এলায়েন্স বাংলাদেশ, গ্লোবাল কল টু অ্যাকশন এগেইনস্ট পোভার্টি ও নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এনআরডিএস)।
এসডিজি অ্যাকশন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও এনআরডিএসের প্রধান নির্বাহী আবদুল আউয়াল বলেন, কভিডের আগের ধারাবাহিকতায় বাজেটে স্বাস্থ্য খাত অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। মহামারির সময়ই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছিল; কিন্তু এরপরও বাজেটে এই খাত প্রত্যাশিত মনোযোগ পাচ্ছে না। টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও বাজেট ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বরাদ্দ খুব একটা বাড়ছে না। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করে, যা বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে অনেক কম।
সবার জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন; কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকরা নিজে সংস্থান করেন। বাংলাদেশের জনগণ তাদের স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজেরাই সংস্থান করতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ১৭ লাখ। এর মধ্যে ৫ লাখ মানুষ চরম দরিদ্রতার মধ্যে বাস করেন। এসব মানুষ পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। অল্পতেই তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। জটিল কোনো রোগে সুচিকিৎসা নিতে পারেন না। চিকিৎসা নিতে গেলে সঞ্চিত অর্থ খরচ করতে হয়, ধারদেনা করতে হয়, অনেক সময় জমিও বিক্রি করতে হয়। ফলে চিকিৎকার কারণেই তারা আরও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোটকথা, চিকিৎসাব্যয় তাদের পুরো জীবনযাপনের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেল।
তাই গবেষকদের মতো আমাদেরও দাবি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো অপরিহার্য। স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচির আওতা প্রসারিত করে এবং স্বাস্থ্যসেবা খরচের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে স্বাস্থ্যের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় কমানো যায়। সরকার আরও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা তৈরি করে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরিষেবাগুলোকে আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে। সরকার সব নাগরিকের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য শিক্ষা, কৃষি এবং পানি ও স্যানিটেশনের মতো অন্যান্য সেক্টরের সঙ্গে কাজ করে স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারকগুলোর সমাধান করতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তার প্রভাব সমাজের নানা জায়গাতেই পড়বে। উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাবার পাশাপাশি জনশক্তির দক্ষতা হ্রাসে যেমন এর প্রভাব পড়ে, পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে সামাজিক-পারিবারিক বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয়। তাই জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের আরও সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া এ থেকে উত্তরণের গতি নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে