বাংলাদেশের নাক কেটে ভারতের যাত্রাভঙ্গ করা সম্ভব না
ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালানো হচ্ছে। প্রচারণায় তারা ভারতীয় পণ্যের বদলে দেশের বা অন্য কোনো দেশের পণ্য ব্যবহার করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিজের একটি ভারতীয় চাদর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। আমার ধারণা ছিল, এরপর বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজ নিজ ঘর থেকে শাড়ি, চাদরসহ ভারতীয় পণ্য রাস্তায় এনে লাগাতার পুড়তে থাকবেন; কিন্তু নয়াপল্টনের পর ভারতীয় পণ্যের আর একটিও বহ্নি উৎসব হয়নি।
ভারতের পণ্য বর্জন ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে, তবে এ বর্জন শুধু মিডিয়ায়। ভারতবিদ্বেষী মনোভাব ১৯৪৭ সালে যা ছিল এখনো তাই আছে, অনুপাত বিবেচনায় কমেওনি, বাড়েওনি। বিএনপি কিন্তু রিজভীর হটকারী সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়নি; ভারতীয় চাদর পুড়িয়ে দেয়াকে বিএনপি রিজভীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছে। বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল, তারা জানে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা শুধু দেশ নয়, দলীয় সরকারের জন্যও অপরিহার্য। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে একবার ভারতকে বাদ দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিল; কিন্তু সফল হয়নি। এক পেঁয়াজের ধাক্কায় বাংলাদেশ বেসামাল হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ পেঁয়াজের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে ধরনা দিয়ে মিশর থেকে ডিম্বাকৃতির যে বড় বড় পেঁয়াজ আমদানি করেছিল তার কোনো ঝাঁজ ছিল না, কারও খাওয়ার রুচি হয়নি।
আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ভারতের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিচ্ছে, রিজভী সাহেব সেই উসকানির ফাঁদে পা দিয়ে দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ না করেই নিজের দামি কাশ্মীরি শালটি পুড়ে দিলেন। রিজভী সাহেব কুমিল্লার খদ্দর না কিনে কাশ্মীরের দামি শাল কিনতে গেলেন কেন? বাম রাজনীতির আমার এক ভাগ্নেকে ‘খদ্দর কাশেম’ না বললে কেউ এলাকায় চিনে না। বাংলাদেশের তাঁত, জামদানি এবং টাঙ্গাইল শাড়ির কদর ভারতেও রয়েছে, আর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশের কসমেটিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতীয় শাড়ির কদর কমার সম্ভাবনা রয়েছে। হজ করে আসার পর আমার স্ত্রীকেও আর শাড়ি পরতে দেখি না। শাড়ি পরলে না কি নারীর আব্রু ঢাকা থাকে না- এমন প্রচারণাও জোরেশোরে চলছে। তবে আমার বিয়ের শাড়ি ভারত থেকে এসেছিল, তা এখনো আলমারিতে আছে। বউকে পোড়াতে বলেছিলাম, রাজি হয়নি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রসঙ্গ ছাড়াই উল্লেখ করেছেন, ভারত পাশে থাকায় জাতীয় নির্বাচনে অন্য কোনো দেশ অশুভ খেলার সাহস করেনি। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে সমর্থন বা দেশগুলোর বিরোধিতা করে থাকে। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম বিবৃতি দিয়ে বরিস জনসনকে সমর্থন করেছিলেন, আবার রাশিয়া সমর্থন করে ডোনাল্ড ট্রামকে। চীনের সমর্থন থাকায় মিয়ানমার গোটা বিশ্বকেই থোড়াই কেয়ার করে। আমেরিকার সমর্থন থাকায় ইসরায়েল ৫৭টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সমর্থন থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারকে হঠাতে শুধু একটি ধাক্কার অপেক্ষায় ছিল বিএনপি। ভারতও এমনই নিজ স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে যাচ্ছে। রাজনীতিতে বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থান পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের মতো। ভারত বিরোধিতা আছে বলেই বিএনপি পাকিস্তানপন্থি এবং চীনপন্থিদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে থাকে। তাই কারণে-অকারণে ভারত বিরোধিতা বিএনপির রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, তা ভেস্তে গেছে ভারতের কারণে। আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলো স্বার্থ ব্যতিরেকে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই চাপ তৈরি করেনি। এমন স্বার্থ ভারতেরও আছে। ভারত চাইবে না তার সীমান্তে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইর ঘাঁটি আবার গড়ে উঠুক, ভারত চাইবে না বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের মতো আবারও ১০ ট্রাক অস্ত্র এনে ভারতের সশস্ত্র গ্রুপের হাতে কেউ তুলে দিক, ভারত চাইবে না বিএনপির খালেদা জিয়ার মতো পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাৎ বাতিল করে তাদের রাষ্ট্রপতিকে আবার কেউ অপমান করুক, ভারত চাইবে না পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির জন্য ফেনী পর্যন্ত দখল করার অপবাদ আবার তাদের ঘাড়ে এসে পড়ুক। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হলে বাংলাদেশ সহজেই ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে পারে। ভারতও এক সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের সংরক্ষণমূলক নীতির কারণে ১৯৭৭ সালে ভারত থেকে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছিল জনপ্রিয় পাণীয় প্রস্তুতকারক সংস্থা কোকাকোলা এবং সফটওয়্যার জায়ান্ট আইবিএম।
ভারতের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ সকলে নিজেদের তৈরি অ্যাম্বাসেডর মোটরগাড়ি ব্যবহার করেছেন দীর্ঘদিন। ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ প্রবল, তারা বাংলাদেশ বেড়াতে এলে কিছুই কেনে না। আর ঈদ এলেই লাখ লাখ বাংলাদেশি কলকাতা নিউমার্কেটে গিয়ে বস্তায় বস্তায় জিনিস কেনে। লাখ লাখ লোক চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়, ঘুরে এসে দল-মত নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি ভারতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে। ভিসা ফি, বিমান-হোটেল ভাড়া, খাবার, পরিবহন, কেনাকাটা প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশিরা ভারতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, সব অর্থ পাচ্ছে ভারত; কিন্তু রিজভী সাহেবের ডাকে বাংলাদেশের মানুষ কেন সাড়া দিচ্ছে না, কেন বিএনপির অন্ধ সমর্থকরাও বয়কট মানছে না, তা রিজভী সাহেব ভালো করেই জানেন। বাংলাদেশের ছোট্ট ভূখণ্ডটি ১৮ কোটি মানুষের খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে, জমির স্বল্পতার কারণে একটা ফসল উৎপাদন করতে গেলে অন্য ফসলের উৎপাদন ছেড়ে দিতে হয়। প্রবাসীদের প্রেরিত টাকায় ফসলি জমি ভরাট হচ্ছে, ইটের ভবন তৈরি হচ্ছে। তাই এখন আলুও আমদানি করতে হয়। আলপিন থেকে উড়োজাহাজ সবই বাংলাদেশ আমদানি করে, আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়ের দ্বিগুণ। তাই ভারতের পণ্য বয়কট করার সুযোগ একেবারেই নেই। কারণ কোন দেশ থেকে কোন পণ্য আমদানি করা হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে না, নির্ধারণ করে ব্যবসায়ী। যেখানে কম মূল্যে পণ্য পাবে ব্যবসায়ী সেখান থেকেই পণ্য কিনবে।
যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে খরচ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। ভারত থেকে বছরে আমদানি হয় কম-বেশি ১৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য, একই পণ্য অন্য দেশ থেকে আনতে ব্যয় হবে ২০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়াও ভারত থেকে আমদানিতে সময় ও পরিবহন খরচ কম লাগে। তাই বেনাপোল দিয়ে আগে প্রতিদিন গড়পড়তা ৩৫০ ট্রাক আসত, ভারত বয়কটের ডাক দেয়ার পর এখন আসে ৪০০ ট্রাক। ভারতীয় পণ্য বর্জনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়া গেলে অবশ্যই এই বর্জন সমর্থনযোগ্য; কিন্তু বাংলাদেশের নাক কেটে ভারতের যাত্রাভঙ্গ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ সারা পৃথিবীতে ভারত যা রপ্তানি করে তার মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ আসে বাংলাদেশে। তাই ভারতীয় পণ্য বয়কট করলে অচল হয়ে যাবে বাংলাদেশ, ভারত নয়। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৬৪৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ভারত বয়কটের আওয়াজ প্রথম শুরু হয়েছে বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ বিরোধীদের তরফ থেকে, বিএনপির নীতি নির্ধারক এখন তারা। এদের প্রচারণায় বিএনপি নির্বাচনের সময়ও বিভ্রান্ত হয়েছে।
ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি হয় ৯৭টি পণ্য। যেসব পণ্যের তালিকা দিয়ে বয়কট করতে বলা হচ্ছে, সেসব পণ্যের আমদানি ব্যয় মোট আমদানির একটি ক্ষুদ্র অংশ। বেশিরভাগ খরচ হয় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, কয়লা, খাদ্যশস্য আমদানির জন্যও কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ভারতের তুলা না হলে বস্ত্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে, ভারত থেকে ইঞ্জিন এবং যন্ত্রাংশ আমদানি না করলে পরিবহন সেক্টর অচল হয়ে যাবে। রিজভী সাহেবকে মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করে ব্যবসা করার জন্য, লোকসান দিয়ে ভারতকে ঠেকানোর জন্য নয়। অবশ্য ডলার সংকট থাকলে আমদানি এমনিতেই কমে যাবে, বয়কটের প্রয়োজন হবে না।
মালদ্বীপ কিছুদিন ভারতের বিরুদ্ধে তর্জন-গর্জন করে এখন জরুরি ভিত্তিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠাতে ভারতকে করজোড়ে অনুরোধ করছে। ভারত মালদ্বীপের অনুরোধে সাড়া দিয়ে পণ্য পাঠাচ্ছে। ঠিক তদ্রূপ বর্জনের ডাক দিয়েও বিএনপি ভারতের কূটনৈতিকদের দাওয়াত করে ইফতার করিয়েছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে ভারতকে পাশে থাকার অনুরোধ করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের বর্জন নিয়ে হিউমারও আছে, কৌতুক করা বলা হচ্ছে, ভারতে সব বর্জন করা বিএনপির পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের স্ত্রীর বাড়ি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে