Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষিত: পর্ব ২

নিয়মের তোয়াক্কা না করে দূষণ ছড়িয়ে চলছে ইটভাটা

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রথম পর্বের পর

রিবেশ আইন, নিয়মনীতি এবং হাইকোর্টের আদেশের তোয়াক্কা না করেই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মাটি, বায়ু, কাঠ এবং ওজোনস্তর নষ্ট করে যাচ্ছে দেশের অবৈধ ইটভাটাগুলো। এসব ইটভাটায় পোড়ানো কয়লা থেকে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ও নাইট্রোজেনের মতো বিষাক্ত পদার্থ, যা চোখ, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলো বাতাসে মিশে ঘটাচ্ছে অ্যাসিডবৃষ্টিও। এতে ফসলের হানি ও নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। আর পিএম২.৫ (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) এর আধিক্যজনিত বায়ুদূষণে ইটভাটার আশপাশের এলাকায় পাখিসহ অন্যান্য প্রাণী কমে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। গবেষকদের ধারণামতে, এই ক্ষতিকর বস্তুকণা ঢাকার লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

মাটি পুড়িয়ে ইট বানানো বন্ধ না করা হলে ২০৪০ সালে দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে বলেও শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, দেশে রয়েছে সাড়ে আট হাজারেরও বেশি ইটভাটা। যার অধিকাংশই অবৈধ এবং সেগুলোই এখন পরিবেশের জন্য বিষফোড়া।

‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ অনুসারে লাইসেন্স ছাড়া কোনো ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনা করা যায় না এবং জ্বালানি হিসেবে ইটভাটায় কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ। ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর এসব বিধান না মানা ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উৎস ইটভাটা। বছরে ইটভাটায় কয়লার ব্যবহার ৪ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন মেট্রিকটন, কাঠের ব্যবহার ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন, মাটির ব্যবহার ২ হাজার ৮৪০ মিলিয়ন সিএফটি এবং কার্বণ নিঃসরণ ১১ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যার ফলে বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা।

নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউর (নিলু) সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য শুধু ইটভাটাগুলোই দায়ী ৫৮ শতাংশ। বায়ুতে ক্ষতিকারক উপাদান পিএম২.৫ (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) এর অন্যতম উৎসও এসব ইটভাটা।

ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড ইভ্যালুয়েট এবং হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউট বোস্টন বলছে, পিএম২.৫ হচ্ছে ক্ষতিকর বস্তুকণা, যার ব্যাস ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটারের নিচে। এই ক্ষতিকর বস্তুকণা খুব সহজেই মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে চলে যায়, যেটি অনেকের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

২০১৩ সালের হিসাব অনুসারে, পরিবেশ আইন না মেনে চলা বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলের ইটখোলাগুলো থেকে ৫৩ হাজার ৩৩৩ টনেরও বেশি পার্টিকুলেট ম্যাটার-১০, ১৭ হাজার ৫৫৭ টন পার্টিকুলেট ম্যাটার-২.৫ এবং ৫৯ হাজার ২২১ টনেরও বেশি সালফার অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যোগ হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বছরে প্রায় ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ বায়ুদূষণের প্রভাবে মারা যান। এর প্রায় ৫৯ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বায়ুতে এসব বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতিতে নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখি হচ্ছে প্রায় ২২০ মিলিয়ন শিশুও ।

আইন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত:
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, ইটভাটা থেকে নির্গত নানা ধরনের পার্টিকুলেট ম্যাটারগুলো প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু- উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব দূষিত উপাদান শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেসপিরেটরি সিস্টেমও, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইটভাটার আশপাশের বাসিন্দাদের মাঝে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।

অন্যদিকে, ইট তৈরিতে ব্যবহৃত মাটিতে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। উচ্চতাপে ক্যালসিয়াম কার্বনেটগুলো ভেঙে ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও কার্বণ ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। প্রতি কেজি ইট তৈরিতে শুধু মাটি থেকেই প্রায় ২৫ গ্রাম কার্বণ ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে, যা বায়ুদূষণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতাকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তিনি জানান, বায়ুতে পার্টিকুলেটস ম্যাটারের উপস্থিতিতে মানুষের মৃত্যুহার আগের তুলনায় তিন গুণ বেড়ে গেছে। আর বায়ুতে মাত্রাতিরিক্ত সালফার ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতিতে মানুষ চোখ, নাক, গলাসহ অ্যাজমাটিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

‘মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বায়ুতে এই দূষিত উপাদানগুলোর উপস্থিতির কারণেই ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে’- ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়নে অনেক আবাসিক এলাকায়ও ইটভাটা দেখা যাচ্ছে। মানুষের বসবাসের জায়গা থেকে ইটখোলাগুলো সরিয়ে নিতে খুব একটা আগ্রহী নন উদ্যোক্তারাও। ফলে দেখা যাচ্ছে, ইটখোলার আশপাশে বসবাসরত মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।

তিনি জানান, অনবায়নযোগ্য জ্বালানি, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বনায়ন ধ্বংসে বায়ুমণ্ডলে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে গ্রিনহাউস গ্যাসের হার। ইটখোলা থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইডও এ ধরনের একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। আবার ইটভাটার ছাই নিষ্কাশিত হয় পাশের নদী বা জলাশয়ে। ওই বর্জ্য পানির সঙ্গে মিশে উৎপাদিত হচ্ছে লেড, ক্যাডমিয়াম, জিংক ও ক্রোমিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত উপাদান, যেগুলো খাদ্যশৃঙ্খল প্রক্রিয়ায় জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। ফলে মানুষ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত জটিল রোগের মুখোমুখি হচ্ছে।

‘অপরিকল্পিত ইটখোলা স্থাপনে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস হার এভাবে বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়ে যাবে।’- আশঙ্কা মনজিল মোরসেদের।

নিয়ম না মানা ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ:
২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর দেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং পরিবেশ সচিবকে এ নির্দেশনা জারি করতে বলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম এবং বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর হাইকোর্ট বেঞ্চ।

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ অনুসারে লাইসেন্স ছাড়া কোনো ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনা করা যায় না এবং জ্বালানি হিসেবে ইটভাটায় কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও দেশের বেশিরভাগ জেলায় শীত মৌসুমকে সামনে রেখে অবৈধ ইটভাটাগুলো কার্যক্রম চালায়।’

তিনি জানান, জ্বালানি হিসেবে ইটভাটায় কাঠ ব্যবহারের প্রস্তুতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিটটি করে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। রিটের শুনানি শেষে দেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা বন্ধে ও জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং অবৈধ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন ও ভাটা কাঠ ব্যবহার বন্ধে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

তিনি জানান, অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং পরিবেশ সচিবকে সব জেলা প্রশাসকদের আইন অমান্য করে চলা ও অবৈধ সব ইটভাটা বন্ধে নির্দেশনা দিতে বলেন হাইকোর্ট।

যা বললেন পরিবেশ উপদেষ্টা:
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন তিন হাজার ৪৯১টি ইটভাটার কার্যক্রম শিগগিরই বন্ধ এবং পার্বত্য এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত সব ইটভাটা স্থানান্তর করা হবে। ইটভাটাজনিত বায়ুদূষণ রোধে আর কোনো নতুন ইটভাটার ছাড়পত্রও দেয়া হবে না।’

ইটভাটার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘লাইসেন্স ও ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ইটভাটা পরিচালনা করা যাবে না। পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন, ইটভাটার আধুনিকায়ন এবং কার্বণ নির্গমণ কমাতে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে এর কোনো বিকল্প নেই।’

চলবে...

আরও পড়ুন
পর্ব: ১
নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব সারা দেশ


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ