স্বাধীনতার স্বাদ বস্তির উলঙ্গ ছেলেটির কাছে পৌঁছে দিব
স্বাধীনতার ৫৫ বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। এত বছর পর মনে পড়ছে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে একটা স্লোগান দিয়েছিলাম, ‘স্বাধীনতার স্বাদ বস্তির উলঙ্গ ছেলেটির কাছে পৌঁছে দিব।’ আজকে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বলছি, পারিনি; কিন্তু স্বাধীন করে দিয়েছি। কীভাবে? এই দেশে একটি স্পঞ্জের স্যান্ডেলের কারখানা ছিল না, ইন্ডেন্টিং ব্যবসা কাকে বলে বাঙালি জানতো না। আজকে সেই বাঙালি কিন্তু জুতা থেকে শুরু করে বিল্ডার্স ব্যবসা, যেখানে ইস্পাতের কোনো খনিজ ছিল না, সেখানে বড় বড় শিপ তৈরি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠায়- সেই অবস্থায় আমরা পৌঁছে গিয়েছি। আমার গ্রামের এক ছেলে হেলিকপ্টার বানিয়ে আকাশে উড়েছে, এটা অহংকারের বিষয়, তাই না? এই ছিল বাঙালি জাতি। সেখান থেকে আমরা এতদূর আগালাম।
স্বাধীনতার যুদ্ধের অনেক স্মৃতি রয়েছে। একটা হলো প্রস্তুতি নিয়ে আরেকটা হলো যুদ্ধ চলাকালীন। যুদ্ধের একটা স্মৃতি মনে পড়ে। আমি যুদ্ধ করি ৯নং সেক্টরের অধীনে। বরিশাল-পটুয়াখলী-ঝালকাঠি এসব অঞ্চলে। একদিন কি করলাম, ৮-৯টা রাইফেল যেগুলোর মাস্কেটের ভেতরে একটা একটা করে গুলি করতে হয়। আরেকটা হলো ম্যাগাজিনে ৬-৭টা ভরে শ্যূট করা যায়। এরকম মাস্কেট ও ম্যাগাজিনসহ আমাদের সম্ভবত ৯টা রাইফেল ছিল। বরিশালের একটি বিখ্যাত খাল আছে, নাম হলো গাবখান খাল। ঝালকাঠি থেকে কাউখালী যেতে খুলনায় রকেট যাওয়ার জন্য। তো, আমরা ওই গাবখান খালের পাশে বসে চিন্তা করছি এই যে এখান দিয়ে পাকিস্তানি আর্মি যায় আমরা কিছু করতে পারব না? দেখতাম যে পাকিস্তানি আর্মিরা একেবারে ড্রেস পরে আছে মনে হয় যেন ওখানে বসেই যুদ্ধ করবে। চতুর্দিকে এলএমজি বসানো। উপরে বালুর বস্তা। তো একদিন আমরা টার্গেট নিলাম- এদিক থেকে একত্রে চারটা ফায়ার করব যাতে পাকিস্তানি আর্মিরা বুঝতে না পারে এটা মাস্কেটের নাকি ম্যাগাজিনের।
আমরা অনেক বন্ধু একেকজন একেকটা টার্গেট নিল। টার্গেটের ভেতরে কেউ নিল সার্চলাইট, কেউ মাস্টার কেবিন এরকমের একেকটা টার্গেট। পাকিস্তানি আর্মিদের এলএমজি গুলিগুলো ছিল স্ট্যান্ডের ওপরে। তাদের গোলাগুলি যাইতেছিল আমাদের মাথার একশ হাত ওপর দিয়ে। আর আমাদের টার্গেটগুলো প্রত্যেকটা সাকসেসফুল। তো আশপাশের গ্রামের লোকজন জানতো না এ ঘটনা। ঘণ্টাখানেক পর দুতিনটা গানবোট আসল। আমরা বুঝলাম যে পরদিন অ্যাটাক হবে। আমরা লোকজনকে বললাম, ঘরবাড়ির আশা ছেড়ে দাও। আগে জানে বাঁচো। তোমরা এলাকা ছাড়। দুদিন পর আশপাশ পুড়িয়ে দিয়েছে একদম। এই একটা ঘটনা।
আরও ঘটনা আছে। সেদিন ছিল ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। বরিশালের স্বরূপকাঠির ওপার ইন্দিরহাটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাঠের বাজার। আমি, আমার সহযোদ্ধা জাহাঙ্গীর বাহাদুর আর সিদ্দিক। করলাম কী- বাঁশের হাওয়াই বাজি আছে না, যেটা মারলে আগুন আকাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এখন অবশ্য দেখা যায় না। স্থানীয় একজনকে ডেকে বাঁশের মধ্যে কিছু ইটের কনা-টনা, খোসা এসব ভরে হাওয়াই বাজি বানিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করি। ছারছিনা পীরের দরবার হলো ওপার। লঞ্চের নাম ছিল গজারিয়া। যেটাতে করে পাকিস্তানি আর্মিরা রওয়ানা দিবে দিবে। আমরা ওই লঞ্চ টার্গেট করে হাওয়াই বাঁজি মারব। ওটার বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠে। মারলাম আর আমরা এদিকে মাইক লাগিয়ে ছেড়ে দিলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ এ দেখে পাকিস্তানি আর্মিরা ব্যাক করে চলে গেল। ওই একটা আনন্দ আর কি।
সবশেষে বলি, স্বাধীনতা এখনো অপূর্ণ। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে, অনবরত চলবে। স্বাধীনতা কখনো শেষ হওয়ার নয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য এর কবিতা দিয়েই বলি- ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৯নং সেক্টর।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে