Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর

প্রাণঘাতী বিপর্যয়ের নির্মম সাক্ষ্য

Rahat  Minhaz

রাহাত মিনহাজ

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

০১৩ সাল বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে খুবই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ একটি বছর। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী যারা রাজাকার-আল বদর নামে কুখ্যাত ছিল, সেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলছিল সে সময়।একাত্তরের গণহত্যার চিহ্নিত ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে  রাজপথে নামে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সচেতন মানুষ ও তরুন শিক্ষার্থীরা। সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিক গণজাগরণ মঞ্চের। অন্যদিকে  বছরের শুরু থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক হিংসাত্মক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল একাত্তরের সেই ঘৃন্য রাজাকার-আল বদরদের সংগঠন জামায়াত-শিবির। পাশাপাশি  পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ব্যানারে চলছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের আন্দোলন।

এর মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রে  গড়ে তোলা হয় কট্টর মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তারা হঠাৎ করেই যুক্তি, বুদ্ধি, বিজ্ঞান চর্চা ও নারী বিদ্বেষী বক্তব্য নিয়ে রাজপথে নেমে নানা অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টায় মেতে ওঠে।  এমনই নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই ওই বছর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকার অদূরে ধ্বসে পড়ে রানা প্লাজা নামে একটি বহুতল ভবন, যে ভবন জুড়ে ছিল বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা, যেখানে কাজ করতেন কয়েক হাজার শ্রমিক। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের গণমধ্যমের দৃষ্টি রাজপথ থেকে চলে যায় সাভারে, হাজার মানুষের আর্ত চিৎকারের সেই বিধ্বস্ত ভবনে। 

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দিনটি ছিল বুধবার। এ দিনের বড় সংবাদ আধেয় ছিল বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. আবদুল হামিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। এদিন সন্ধ্যায় তিনি বঙ্গভবনে শপথ নেন; কিন্তু এই শপথের আগেই গণমাধ্যমের দৃষ্টি চলে যায় ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারে। ২০১৩ সালে আমি এটিএন বাংলায় জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ২৫ এপ্রিল ছিল ১৮ দলীয় জোটের টানা ৩৬ ঘণ্টা হরতালের দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি। সকালে আমার হরতাল ডিউটি ছিল। এটিএন বাংলার হয়ে আমি সাধারণত হরতালে মহাখালী ও তিতুমীর কলেজ এলাকার দায়িত্ব পালন করতাম। ওই দিন ভোরেও আমি তিতুমীর কলেজে যাই। কর্মসূচি ছিল নির্ঝঞ্ঝাট। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমাকে ফোন করেন এটিএন বাংলার প্রধান প্রতিবেদক মাহমুদুর রহমান। বলেন, তুই কই? বললাম তিতুমীর কলেজের সামনে? নির্দেশ দিলেন, তুই এখনি সাভারে যা। একটি বিল্ডিং ভেঙে পড়েছে। অনেক মানুষ মারা গেছে।

হরতাল তখনো চলছিল। রাস্তায় গাড়ি ও মানুষ কম। গাবতলী হয়ে পৌঁছালাম সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে। তখন প্রায় সাড়ে ১০টা। প্রচুর মানুষ। হট্টগোলে। ধুলা। তাদের পাশ কাটিয়ে যা দেখলাম তা ছিল ভয়াবহ এক দৃশ্য। কনক্রিটের একটা এলোমেলো স্তূপ। ব্র্যাক ব্যাংকের একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশ ও অপেশাদার স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আহতদের উদ্ধার করে পাঠানো হচ্ছে এনাম মেডিকেলে। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানলাম, ৯ তলা এই ভবনটির নাম রানা প্লাজা। ভবনটি ধসে পড়ে সকাল ৮টা ৪৭ মিনিটে। এই ভবনে ছিল ৫টি পোশাক কারখানা। জলাশয়ের ওপর গড়ে ওঠা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত ও নকশাবহির্ভূত এই ভবনে ছিল ২৭০টি দোকান, শপিং কমপ্লেক্স ও বেসরকারি ব্যাংকের শাখা।

এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন হাজার হাজার মানুষ, যাদের নিয়েই মাত্র ৩-৪ সেকেন্ডে পুরোপুরি দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে ভবনটি। ভেতরে আটকা পড়েন হাজারো তাজা প্রাণ। আরও খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারি, ভবনটিতে আগের দিন ফাটল দেখা দিয়েছিল, যা দেখে শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভবনের মালিক, যুবলীগ নেতা সোহেল রানা শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। মিথ্যা আশ্বাস দেন। ভবনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ এমন ঘোষণাও দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার। তিনি বলেছিলেন ‘ফাটল অস্বাভাবিক কিছু না।’ কিন্তু হায়! ২৫ এপ্রিল সকালেই মৃত্যুকূপে পরিণত হয় ভবনটি, যা এখনো পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতম শিল্প দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়। যাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১৩৫ জন শ্রমিক। আহত হয়েছিল ৩ হাজারের বেশি। অনেকেই অঙ্গহানির শিকার হয়েছিলেন। কেউ হারিয়েছিলেন দুই হাত বা দুই পা। রীতিমতো এক নরকযজ্ঞ।

ধ্বংসস্তূপের ছবি, ভক্সপপ ও অন্যান্য তথ্য উপাত্ত নিয়ে কারওয়ানবাজারে এটিএন বাংলার অফিসে ফিরে আসি। সব কিছু জমা দিয়ে চলে যাই, মোহাম্মদপুরের বাসায়। সারা গায়ে তখন ধুলা। বাসায় গিয়ে গোসল করে আবার টিভির সামনে বসি। সব টিভিতেই রানা প্লাজা। এমনকি বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা সব আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের প্রধান শিরোনাম রানা প্লাজা বিপর্যয়। দেশি-বিদেশি টিভিগুলো একটানা লাইভ সম্প্রচার করছিল।

২০১৩ সালে আমি ছিলাম অবিবাহিত। প্রথম আলোর দুই সাংবাদিক-সহপাঠীর সঙ্গে থাকতাম মোহাম্মদপুরে। সন্ধ্যার সময় অফিস থেকে আবার ফোন এলো। আমাকে রাতের জন্য রানা প্লাজায় যেতে অনুরোধ করা হলো। সকালে একবেলা অফিস করেছি, আবার রাতের ডিউটি। রাত ১২টার পর আবার গেলাম রানা প্লাজার সামনে। গত ১২-১৫ ঘণ্টায় এই ভবন ধসের ভয়াবহতা সবার সামনে পরিষ্কার হয়েছে। কংক্রিটের স্তূপে আটকে পড়া মানুষের আকুতি সহ্য করার মতো ছিল না। ভেঙে পড়া ছাদের ভেতর দিয়ে গর্ত করে করে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল। তবে বেশির ভাগ উদ্ধারকারী ছিলেন অপেশাদার, সাধারণ মানুষ। বৈশাখের তীব্র গরম উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা আটকে পড়াদের উদ্ধারের প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন।

রানা প্লাজা ধসে নিহতদের মরদেহ নেয়া হয়েছিল অধরচন্দ্র মডেল হাই স্কুলের মাঠে। রাত ২টার পর আমি ওই মাঠে যাই। সেখানেও প্রচণ্ড ভিড়। একটা ছোট্ট নীল পিকআপ ও অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ আনা হচ্ছিল। একের পর এক মরদেহ আসছে। যাদের স্থান হচ্ছে লম্বা টানা বারান্দায়। আমি আর আমার সহকর্মী ক্যামেরাপারসন পলাশ নিউজের কাজ করে যাচ্ছিলাম। শত শত মানুষ তাদের হতভাগ্য স্বজনের মরদেহ শনাক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কেউ কেউ উচ্চৈঃস্বরে কাঁদছিলেন। এক ভীতিকর পরিস্থিতি। এখানে দায়িত্বরত পুলিশের বক্তব্য নিই। যারা তথ্য সংরক্ষণ করছিলেন। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলি। কাজ শেষে ভোর ৪টা দিকে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

এক পর্যায়ে এক জায়গায় বসে ভাবছিলাম, এই লম্বা লাশের সারির মানুষ মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেও জীবিত ছিলেন। তাদের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন ছিল। হয়তো গত রাতে এ সময় অনেকেই স্বামী বা স্ত্রীর উষ্ণ আলিঙ্গনে ছিলেন; কিন্তু এখন তারা মৃত। বিনা কারণে, অন্যের অবহেলায় তাদের শরীর থেঁতলে গেছে। কংক্রিটের চাপে তীব্র যন্ত্রণায় বের হয়ে গেছে প্রাণবায়ু। আহা! কি মর্মান্তিক, কি নিষ্ঠুর মৃত্যু। কতটা হতভাগ্য এই সেলাই শ্রমিকরা। মৃত্যুর মিছিলের খবর সংগ্রহ করে করে ক্লান্ত ও বিষণ্ন মনে অফিসে ফিরি ভোরবেলা।

অফিসে বসে সংবাদ লেখার সময় ফেসবুকে লগইন করি। ফেসবুকের ফিডে শোকের ছায়া। উদ্ধার তৎপরতার নানা খবর। তবে একটা খবর আমাকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল। তখন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি এই ভবনধস নিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।’ একজন মন্ত্রী এমন কথা বলেছেন বিষয়টি আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এরপর আমি অনলাইনে বিবিসির সংবাদ শুনি। ভয়াবহ পর্যায়ের বিস্মিত হই। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ, একজন মন্ত্রী কীভাবে এসব কথা বলতে পারেন, তা ভেবে আমি কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। এক বুক হতাশা আর বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ