কালো টাকার মালিকদের দৌরাত্ম্য বাড়ানোর বাজেট ২০২৪-২৫
জাতীয় বাজেট শুধু বার্ষিক আয়-ব্যায়ের হিসাব নয় বরং বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট দেশের জনগণের আস্তা এবং বিশ্বাস অর্জনের হাতিয়ার। সরকারের ভিশন ও লক্ষ্য অর্জনে বাজেট শুধু দিক নির্দেশনার মধ্যেই সীমিত নয় বরং সরকার দেশের প্রবৃত্তি অর্জনে, সম্পদ আহরণে বা অন্যবিধ সমস্যা সমাধানে কী কী উদ্যোগ নিচ্ছেন বা নেবেন এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা কীভাবে পূরণ করছেন বা করবেন তার দিক-নির্দেশনা থাকবে।
এবারের বাজেট পেশের পর পরই বাজারে অস্থিরতা লক্ষ্য করা হচ্ছে, যার অর্থ সরকারি কর্মচারীরা যে বাজেট তৈরি করেছেন তা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বা আস্থা অর্জনে সফলকাম এখনো হয়নি। বরং সৎপথে যারা অর্থ উপার্জন করবে, তাদের ওপর ট্যাক্স ধার্য হয়েছে শতকরা ৩০ শতাংশ এবং যারা অসৎ উপায়ে বা ঘুষ-চুরি করে উপার্জন করবে, তাদের ট্যাক্স হচ্ছে ১৫ শতাংশ বা অর্ধেক। জনগণ মনে করেন, এর মাধ্যমে দুর্নীতি আরও বাড়বে, টাকা পাচারও আরও বাড়বে। কালো টাকার একটি অংশ হচ্ছে মার্কেট দাম এবং সরকারি নির্ধারিত দামের ক্ষেত্রে বিরাট ফারাক। সুতরাং জমি বিক্রি, বাড়িঘর বিক্রি ইত্যাদির ক্ষেত্রে মার্কেট প্রাইসে বিক্রি করে আয়কর নির্ধারণে একই মূল্য গ্রহণ করলে কালো টাকার এত বাড়াবাড়ি বা দৌরাত্ম্য হতো না। কালো টাকা যারা সাদা করতে চাইবেন তারা তাদের ট্যাক্স ব্রাকেট অনুযায়ী ট্যাক্স দেবেন। তাছাড়া আরো ৫/১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে সাদা করার ব্যবস্থা করলে বিষয়টি অনৈতিক হতো না।
বর্তমান প্রতিকূল পরিবেশে বাজেট তৈরি করা মোটেই সহজ নয়। দেশে বড় বড় সমস্যা যেমন: (১) মুদ্রাস্ফীতি কমানো, (২) অধিকতর কর্ম সংস্থান বৃদ্ধি, (৩) রাজস্ব বৃদ্ধি, (৪) ব্যাংক ঋণ কমানো যাতে crowding-out effect না দেখা দেয়, অর্থাৎ সরকার ব্যাংক থেকে সব ঋণ নিয়ে নিলে ব্যবসায়ীরা কোনো ঋণ পাবে না এবং তারাই তো বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থান বাড়ায় তা পারবে না, (৫) প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বা বাড়ানো, (৬) বিনিয়োগ বাড়ানো, (৭) ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্তা ফিরানো, (৮) মানুষের প্রত্যাশা পূরণ ইত্যাদি। এবারের বাজেটে এগুলো আলোচনায় এসেছে, তবে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেই যার ফলে জনমনে এত নিরাশা।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত অনেক বাজেট দিয়েছেন এবং তার বাজেটগুলোতে লক্ষ্য, দিক-নির্দেশনা এবং বিভিন্ন বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। তা ছাড়া তাতে নতুন নতুন ইনোভেশন বা চমক ছিল। বিশেষ করে, জেন্ডার বাজেটিং, জেলা বাজেট, শিশুদের বাজেট, Public-Private Partnership, decentralization of budget ইত্যাদি। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা চান, অর্থাৎ জনগণকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করা তা তার বাজেটে ছিল। তিনি একাধিক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাজেট প্রস্তুত করতেন। এবারের বাজেট প্রস্তাবনায় তা প্রভাবিত হয়নি। এই প্রতিকূল পরিবেশেও কোনো চমক নেই বা আশার দিক-নির্দেশনা নেই।
গত দেড় বছর ধরে দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে পারছে না আর আগামী ৬ মাসে তা ৯ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নেমে আসবে তা জনগণ বিশ্বাস করতে পারছে না। তাছাড়া রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন দরকার তা এ বাজেটে অনুপস্থিত। প্রচলিত নিয়মে যারা আয়কর দেয় তাদের ওপর আরও অধিকতর করের ভোজা আরোপিত হবে এবং দেশের বৃহত্তর জনগণ এবাজেটে করের আওতামুক্ত থাকবে এটা দেশের জন্য মঙ্গলকর নয়।
করজালের পরিধি এবং রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন যারাই জাতীয় পরিচয় পত্র (NID) আছে তাকেই টেক্স রিটার্ন দাখিল করা এবং বর্তমান TIN নম্বর কোম্পানিরগুলোর জন্য বরাদ্দ করা। ডিজিটাল বাংলাদেশে এ নিয়ম চালু হলে টেক্স বেইস কয়েক গুণ বাড়বে এবং রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ও অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে বৈ-কি। তাহলে সরকারকে অধিকতর ঋণের বোঝা বহন করতে হবে না। প্রাক্কলন অনুযায়ী বর্তমান নিয়মে আয়ের শতকরা ২৩ শতাংশ ভাগই ঋণের সুদ বাবদ ব্যয়িত হবে, যা দেশের জন্য সুখকর নয়।
লেখক: সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সভাপতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে