বাজেট ২০২৪-২৫
সংস্কৃতি খাতে প্রস্তাবিত বাজেট বাড়লেও হতাশাজনক
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকার বাতিঘর বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল কয়েকজন লেখক-চিন্তকের সঙ্গে। বিদেশফেরত এক অধ্যাপক ও লেখক বলছিলেন, বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিন্তার ক্ষেত্র উন্নতি করতে হলে প্রচুরসংখ্যক বিদেশি বই বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। শুধু সাহিত্য নয়, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, গবেষণা, প্রযুক্তি সব বিষয়ের বই-ই প্রচুর অনুবাদ প্রয়োজন। তখন আরেক লেখক সরস মন্তব্য করেন, অনুবাদের জন্যই বাজেটে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকা উচিত। আরেক লেখক ভ্রুকুটি করে বলেন, ১ হাজার কোটি এখন কোনো টাকা!
বাংলাদেশের বর্তমান লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেটের আকারে ১ হাজার কোটি টাকা আসলেই তেমন টাকা নয়। যে কোনো বড় একটা অবকাঠামো নির্মাণ করতেই ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়। একটা ইপিজেড নির্মাণ করতেই লাগে কয়েক হাজার কোটি টাকার বেশি; কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সমগ্র সংস্কৃতি খাতেই বাংলাদেশের বাজেট প্রতি অর্থবছরে ১ হাজার কোটি টাকার অনেক কম বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ সালের বাজেটে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ ছিল ৬৩৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৯৯ কোটি টাকা। আর এবারের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্কৃতি খাতে বাজেট মাত্র ৭৭৯ কোটি টাকা। বাজেটের আকার যেখানে ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ১ শতাংশের অনেক নিচে। গত বছরের বাজেটের চেয়ে তা ৮০ কোটি টাকা বেশি হলেও দ্রব্যমূল্যের বিচারে তেমন বেশি বেড়েছে বলা যাবে না। শতাংশের হিসাবে যা শূন্য দশমিক ১০। প্রতি বছর বাজেটের আকার যেভাবে বাড়ে সংস্কৃতির কাঠামো-পরিকাঠামো সেভাবে বাড়ছে না।
মূল বাজেটের অন্তত ১ শতাংশ সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দেয়ার জন্য গত কয়েক বছর ধরেই দাবি জানিয়ে আসছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। এ নিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচিও পালন করেছে। তবুও প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতিকর্মীদের প্রত্যাশার প্রতিফলন হয় না বলে অভিযোগ তাদের। গত ৩১ মে বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে ‘জাতীয় বাজেট: সংস্কৃতি খাতে এক শতাংশ বরাদ্দের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক উদীচীর এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটের আকার বাড়লেও সংস্কৃতি খাত ‘উপেক্ষিত থেকে গেছে’ মন্তব্য করে হতাশা প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রান্তিক মানুষের সংস্কৃতির বিকাশে এই খাতে ন্যূনতম এক শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন তারা। উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। সেই বাজেটেও সংস্কৃতি খাত গুরুত্ব পেয়েছিল; কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও সংস্কৃতি খাতকে অবহেলা হতাশাজনক।’
নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘একসময় সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে পরামর্শ নিতেন রাজনীতিবিদরা। এখন আর সেই অবস্থাটা নাই। প্রতি বছর আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনকে ৫০-৬০ হাজার টাকা করে অনুদান দেন। এটা এমনভাবে দেয়া হয় যেন মনে হবে তারা দয়া করছেন। এটা অনুদান, দয়া নয়; এটা সংস্কৃতিকর্মীদের অধিকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি বাজেটে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ না বাড়ানো হয়, তা তো ওই একইভাবেই চলবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পুরোপুরি আমলানির্ভর, তারা সংস্কৃতির উন্নয়নের কোনো কাজই করে না। আমি তো মনে করি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বন্ধ করে দেয়া দরকার। এই মন্ত্রণালয় তো সংস্কৃতির কোনো কাজেই আসছে না।’
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ‘মূল বাজেটের অন্তত ১ শতাংশ বরাদ্দের দাবির পাশাপাশি তার যথাযথ ব্যয়ের পরিকল্পনাও থাকতে হবে। কেন আমরা বরাদ্দ চাইছি, সে বিষয়েও স্পষ্ট হতে হবে। ১ শতাংশ বরাদ্দ দিলেই সেটা যথাযথ ব্যয় করার সক্ষমতা আছে কি না, তাও দেখতে হবে।’
১৯৮৮ সালে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় নামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। দেশজ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সমকালীন শিল্প-সাহিত্য সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার প্রসার ও গবেষণা-উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ-উৎকর্ষসাধন মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য। ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের অধীন ২১টি দপ্তর ও সংস্থা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দপ্তরগুলো হলো: প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। এতটুকুই থাকল। বাকিগুলোর নাম জানতে চাইলে কেউ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সামান্য অর্থে এত দপ্তর কীভাবে সামলায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়?
বাজেটের অর্থ পরিচালন ও উন্নয়ন খাত- এ দুই ভাগে খরচ করে মন্ত্রণালয়। পরিচালন খাতের মধ্যে আছে নগদ মজুরি ও বেতন, অনুষ্ঠান-উৎসব, বিশেষ অনুদান, কল্যাণ অনুদান, গবেষণা, বইপুস্তক বাবদ মঞ্জুরি, সাংস্কৃতিক মঞ্জুরি। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় সাংস্কৃতিক মঞ্জুরিতে। অন্যদিকে উন্নয়ন খাতের অর্থ ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণ, সম্প্রসারণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম পরিচালনায়। গত ৩ মে মন্ত্রণালয়ের হিসাব বিভাগ জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন বরাদ্দ ছিল ৪৩৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আর উন্নয়ন বরাদ্দ ২৬২ কোটি ৮ লাখ টাকা। মোট বরাদ্দ ৬৯৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
দেখা যাচ্ছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পরিচালন-ব্যয় মেটাতে গিয়েই বেশির ভাগ অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে। বাকি উন্নয়ন পরের কথা, বার্ষিক যেসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ম-মাফিক পরিচালনা করতে হয় তা পরিচালনা করতে গিয়েও সাংস্কৃতিক দপ্তরগুলো হিমশিম খায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো চলে না চলার মতো করেই, কেবল চলার জন্য চলা। তা দিয়ে যে জনগণের সাংস্কৃতিক মান খুব উন্নত হয় বলা যাবে না। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড দেখলেই আমরা তা বুঝতে পারব। বাংলা একাডেমির কি নিজস্ব কোনো গবেষণা আছে? উল্লেখযোগ্য বইয়ের অনুবাদ আছে? উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই। কয়েক বছর ধরেই এ নিয়ে বাংলা একাডেমি সমালোচনার শিকার হচ্ছে; কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। বাজেট না বাড়লে বড় ধরনের কোনো কাজ হাতে নেয়াও সম্ভব না।
সংস্কৃতি একটি জাতি-রাষ্ট্রের প্রাণ। সুস্থ সংস্কৃতি বিনষ্ট হলে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ বাড়ে। তরুণরা নেশায় আসক্ত হয়, বিশেষ শ্রেণিপেশার মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত ও অসাম্প্রদায়িক হয়ে পড়ে। দেখা গেছে, যেসব দেশে সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশ হয়েছে সেসব দেশে জেলখানার সংখ্যাও কমে গেছে। বিপরীত দিকে আমাদের দেশে যে ক্রমাগত নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছে তার কারণ মানুষ সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি আজ অপসংস্কৃতির করালগ্রাসে নিমজ্জিত।
শিক্ষার সঙ্গেও সংস্কৃতির একটা গভীর সম্পর্ক আছে। যে দেশের সংস্কৃতি উন্নত নয় সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও ভঙ্গুর। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। এর কারণ ছাত্রছাত্রীরা সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গেছে। বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েদের দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আর দেশীয় সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার দায়ভার রাষ্ট্রের কাঁধে। সংস্কৃতি খাতে বাজেট না বাড়ালে তা কী করে সম্ভব?
আরও দুঃখজনক বিষয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তরগুলোর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আশি ভাগই রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। তার মানে দেশের আশি ভাগ মানুষ আসলে রাষ্ট্রীয় পরিচালনাধীন সংস্কৃতিচর্চার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাই দেখা যাচ্ছে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে নানাভাবে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। সংস্কৃতি খাতে বাজেট বাড়ানো না গেলে দেশের সবাইকে সংস্কৃতিচর্চার আওতায় আনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মোট কথা, সংস্কৃতিই একটি জাতির মানবিকচর্চার বাহন। সংস্কৃতি বিনষ্ট হলে আর সবই বিনষ্ট হয়ে যায়। হাজার বছর ধরে এই বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মানুষ নিজের আনন্দে, মনের তাগিদে গান-নাটক-যাত্রাপালা ইত্যাদি নানা লোকশিল্পচর্চা করেছে; কিন্তু আধুনিক সময়ে শিল্পচর্চার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও পৃষ্ঠপোষকতা। যেহেতু হাজার বছর ধরে এই বাংলার মানুষ পরাধীন ছিল সেহেতু রাষ্ট্রীয় কোনো আনুকুল্যও এদেশের শিল্পীরা কখনো পাননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ গড়ার কাজে যখন আত্মনিয়োগ করেন অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশের অন্যান্য অবকাঠামো যতটা উন্নত হয়েছে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার সিকিভাগও উন্নত হয়েছে বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও এ বিষয়ে উদাসীন বলেই মনে হয়।
অন্যান্য অবকাঠামো দৃশ্যমান; কিন্তু সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতা অনেকটাই অদৃশ্য থাকে। সংস্কৃতিচর্চার অভাবটা বরং বোঝা যায় সমাজের নেতিবাচক দিকগুলো দিয়ে। অর্থাৎ একটা সমাজে নেতিবাচক কাজকর্ম যত বাড়বে ততই বোঝা যাবে সে সমাজে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার অভাব রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা সবচেয়ে বেশি দরকার সে-বিষয়ে উদাসীন থাকা খুবেই হতাশাজনক।
এ বিষয়ে সরকারের উদাসিনতার পাশাপাশি সংস্কৃতিকর্মীদের উদাসিনতা আছে বলতে হয়। যদিও তারা আরেকটু বেশি বাজেট চেয়েছেন; কিন্তু বাজেটের গুরুত্বটা সরকারকে ঠিক মতো বোঝাতে পেরেছেন বলা যাবে না। আর বাজেটের আগে আগে একটা সেমিনার করেই তা বোঝালে হবে না। সংস্কৃতিক্ষেত্রে আরো বেশি বাজটের গুরুত্ব নিয়ে সারা বছর ধরেই আলোচনা থাকতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে