আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য বাজেটে পুরোপুরি কমিটমেন্ট থাকতে হবে
বাজেটের আয়-ব্যয়ে আর্থিক খাত যুক্ত না থাকলেও বাজেট ঘাটতি পূরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ব্যাংক খাত। সিকিউরিটি মার্কেট এখনো সে অর্থে সহায়ক হয়ে উঠেনি। আর্থিক খাতের সংস্কারের এই মৌসুমে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা ও অন্যান্য খাতকে এগিয়ে নিতে বাজেটের প্রতিশ্রুতি কতটা প্রয়োজন। এসব বিষয় নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি সেলিয়া সুলতানার সঙ্গে আলাপ করেছেন বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী।
ভিউজ বাংলাদেশ: আর্থিক খাতের সংস্কারে অনেক নীতি নেয়া হচ্ছে। নট পারফর্মিং লোন- এনপিএল (খেলাপি ঋণ) যেটি কম দেখানো হতো, কোনো রাখঢাক ছাড়াই আমরা দেখেছি এর পরিমাণ মূলত অনেক বেশি। তবে কিছু উন্নতি হচ্ছে। বাজারের ওপর ছাড়া হয়েছে এক্সচেঞ্জ রেট, সব মিলে কতটা বাজেট সহায়ক হবে আর্থিক খাত? কারণ সরাসরি না হলেও আর্থিক খাত থেকে সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণের চাহিদা থাকে আবার বেসরকারি বিনিয়োগে আর্থিক সরবরাহ জড়িত।
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: বাজেট হলো ইনকাম এক্সপেন্ডিচার স্টেটমেন্ট। আর্থিক খাত থেকে সরকার ধার করে এখানে ইনকাম এক্সপেন্ডিচার সেভাবে জড়িত নয়। যোগাযোগটা সেভাবে যেহেতু সরকার তার ঘাটতি পূরণ করতে আর্থিক খাত থেকে অর্থ নেন। বিষয়টি হলো আমরা চাই না সরকার এভাবে করুক। তাতে আমাদের আর্থিক খাতেরই লাভ হবে, সরকারেরও লাভ হবে। দুইভাবে হতে পারে। যেভাবে আপনি বললেন, সরকার তার সিংহভাগ ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়। ব্যাংক থেকে যদি সরকার সব টাকা নিয়ে যায় তাহলে প্রাইভেট সেক্টরের জন্য কোনো টাকা থাকে না। এটা ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট।
ভিউজ বাংলাদেশ: সরকার তাহলে এটি কোথা থেকে ধার করবে? অন্য খাতগুলো কি ততটা প্রস্তুত?
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: সরকার এটি নেবে সিকিউরিটি মার্কেট থেকে। তাতে আমাদের সিকিউরিটি মার্কেট বড় হবে। বন্ড মার্কেট বড় হবে। যতক্ষণ সিকিউরিটি মার্কেটে সরকারের বন্ড মার্কেটের উন্নতি না হবে ততক্ষণ কর্পোরেট বন্ড মার্কেট ডেভেলপ করে না। অর্থাৎ দুই দিকেই উন্নতি ঘটবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: তাতে সরকারের খরচ বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়।
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: তা বাড়ুক, তাতে তো একটা বিশাল বাজার ডেভেলপ করবে ও গতিশীল হবে। সে সুবিধা আপনাকে দেখতে হবে। সারা বিশ্বেই এটি নিয়ম। যুক্তরাষ্ট্রে ১ টাকাও ব্যাংক থেকে ধার নেয়া হয় না। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, ব্যাংক অব টোকিও, ১ টাকাও ধার করে না ব্যাংক থেকে। এভাবেই সারা বিশ্বে চর্চা হয়। আমার মনে হয় সরকারের সদিচ্ছা জরুরি। আমি চাই না এভাবে চলুক- সরকারের এই একটা পদক্ষেপই যথেষ্ট।
ভিউজ বাংলাদেশ: সিকিউরিটি মার্কেট ছাড়াও সরকারের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সরাসরি যারা জড়িত তারা হলো এনবিআর বা রাজস্ব বিভাগ। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সার্বিক পরিস্থিতির কারণে সবাই করছাড়ের আবেদন করছে।
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: না না, সবার জন্য করছাড় হতে পারে না। এমনিতেই সারা বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে জিডিপির কর খুবই কম। তাহলে আবার কিসের ছাড়। ছাড় ও সুবিধা শুধু কর্পোরেট সেক্টর ব্যবহার করে। অযাচিতভাবেও অনেক সময় ছাড় নেন তারা। বরং করজাল বাড়াতে হবে। মাত্র ৮% থেকে ৯% কর দেন। এটি কোনো কথা হলো? সর্বনিম্ন ১০-১২% হওয়া উচিত এই হার।
ভিউজ বাংলাদেশ: বিনিয়োগ বাড়াতে করছাড়ের প্রয়োজন আছে কিনা? কারণ এসএমই ও স্টার্টআপদের স্বক্ষমতা আর যারা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আছে দুজনের অবস্থা তো সমান নয়।
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: যারা অযাচিতভাবে পেয়ে এসেছে এতদিন তাদের আর করছাড়ের সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। তবে স্টার্টআপ ও এসএমইতে করছাড় ও ফিস্কেল ইনসেন্টিভ সুবিধা দিতে হবে। এই খাতের উদ্যোক্তারা কর ফাঁকি দেয় না। বরং দিতে চায়। এই মুহূর্তে কর ফাঁকির রাস্তাগুলো বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কর আহরণ কম করবে সেটি বলছি না, সক্ষমতা অনুযায়ী কর আহরণ বাড়ানো প্রয়োজন। দেখুন, এই যে আইএমএফের সঙ্গে সেটেলমেন্টে রাজস্ব আহরণ একটি বড় বিষয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: যদিও বাজেটের আকার কমছে; কিন্তু বাজেটে বিদেশি ও দাতা সংস্থার ঋণ বা সহায়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: আমরা আইএমের অর্থটি নেব, কারণ তারা আমাদের অর্থনীতিকে যেভাবে ইভাল্যুয়েশন করে সেটি অন্য দাতা সংস্থাগুলোর জন্য বেঞ্চমার্ক। বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও অনেক ক্ষেত্রে কনফিডেন্স নির্ভর করে দাতা সংস্থাগুলোর কনফিডেন্সের ওপর। তারা মনে করে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সে উদ্দেশ্যে আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঋণ আমরা নেব। নয়তো এটি আমাদের না হলেও চলে। এছাড়া ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করাও জরুরি; কিন্তু চিন্তা করতে হবে দেশের ভেতরেই লোকাল ক্রেডিট বাড়ছে না। দেশের বিনিয়োগকারীরা উন্নতি করলে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। এর জন্য কস্ট অব বিজনেস (ব্যবসার খরচ) কমাতে হবে, ব্যবসা উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আর্থিক খাতের সংস্কারে বাজেটের কমিটমেন্ট কতটা জরুরি?
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য বাজেটে পুরোপুরি কমিটমেন্ট থাকতে হবে। সরকার যদি বাজেটের মাধ্যমে বার্তা দেয়- আমরা আর্থিক খাতের উন্নতি দেখতে চাই, এটির প্রভাব অনেক বেশি। আমি চাই এই বাজেটের মাধ্যমে সরকার এই আশাবাদ ব্যক্ত করুক। আমরা চাই ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফিরে আসুক। ব্যাংকগুলোতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। কারণ ব্যাংক খাত আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক খাত। সহায়তা না পেলে ঋণ খেলাপিরা এত বাড়তে পারে না। সরকার বাজেটে ডিক্লেয়ার করুক- আমরা এ বছর এনপিএল বাড়তে দেব না। সরকারের এই ইচ্ছাই যথেষ্ট। এখন আমরা দেখছি ব্যাংক খাতে এনপিএল কমেছে, সুশাসন ফেরত আসছে। তাই না! সরকার তো কিছু বলেনি সরাসরি; কিন্তু পরিবেশই এমন যে সবাই তার ঋণ ফেরত দিচ্ছে। সরকার যদি পুরোপুরি কমিটেড হয় আর্থিক খাতের উন্নতি হবে। আমানতকারীরাও ইতিবাচক মনোভাব রেখে ফিরবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্য।
তৌফিক আহমদ চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে