আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৪ বছরের বাজেট
২০০৬ সাল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। ওই সময় ভোটার তালিকায় গড়বড় এম এ আজিজ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগ হয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সব মিলিয়ে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা চলে যায় সেনানিয়ন্ত্রিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে।
এরপর দুই বছর সময়জুড়ে ছবিসহ ভোটার তালিকার পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করে ওই সরকার। শেষমেশ প্রতিদিনের নানা নাটকীয়তা পেরিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২৬৩ আসনে জয় পায়। সেই সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের ঘোষিত ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করে তরুণ ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে সমর্থ হয়। ওই নির্বাচনে চারদলীয় জোট ৩৩টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দলে বসে বিএনপি। আওয়ামী লীগের ওপর সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়। সেই প্রত্যাশা পূরণে গত ১৪ অর্থবছরে আওয়ামী লীগ ঘোষিত বাজেটে নানা চমক রাখার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক ছিল ‘বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন’।
বলা যায়, ১৪ বছরজুড়ে বাংলাদেশ শুধু বড় স্বপ্নই দেখেনি, সেই স্বপ্নপূরণে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু টানেল, বঙ্গবন্ধু রেল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনাল, গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছে। একই সঙ্গে সারা দেশকে ডিজিটালাইজেশন করে ডিজিটাল বাংলাদেশকে সার্থক করা হয়েছে। এবার সেই ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। আসন্ন বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের একটি রূপকল্প থাকার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
মহাজোট সরকারের প্রথম বাজেট ২০০৯-১০
মহাজোট সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দায়িত্ব নেয়ার পর ২০০৯ সালের জুনে প্রথম দফায় বাজেট ঘোষণা করা হয়। প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট ঘোষণার সময় বিদ্যুৎ জ্বালানি অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণের ইঙ্গিত দেন। সেই অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে তখন সারাবিশ্বই মন্দার কবলে পড়েছিল। ফলে সরকারকে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সঙ্গে মন্দা মোকাবিলায় জোর দিতে হয়েছিল।
পরিচালন এবং অনুন্নয়ন মিলিয়ে ৮৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়; কিন্তু সংশোধিত বাজেট অর্থবছরের শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ৮২ হাজার ২৩ কোটি টাকা। ওই বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিবি) বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; কিন্তু অর্থবছরের শেষে এডিবি কাটছাঁট করে ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ওই বছর ডিসেম্বরে মিস্টার মুহিত জাতীয় সংসদে বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘২০০৯-১০ অর্থবছরের যে বাজেট আমি এই মহান সংসদে পেশ করি সে সম্বন্ধে বলেছিলাম যে, সেটি ছিল সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের অগ্রযাত্রার প্রথম সোপান। আমি আরও বলেছিলাম, বাজেট প্রস্তাবাবলি প্রণয়ন করা হয় তিনটি বিষয় বিবেচনা করে। যথা- দেশে মন্দা মোকাবিলার প্রস্তুতি, সম্পদ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের সক্ষমতা। একই সঙ্গে আমি এও বলেছিলাম যে, আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয়েছে জনগণের বিশাল প্রত্যাশা। আমি নিশ্চিত করেছিলাম যে, আবেগ বা উচ্চাভিলাষ নিয়ে বাজেট প্রণয়ন হয়নি, হয়েছে বাস্তবতার নিরিখে এবং আমাদের উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা নিয়ে।
বাজেট ২০১০-১১
২০০৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ওই অর্থবছরে অর্থাৎ ১ জুন ২০১০-এ দেশে বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করেন। তবে বিএনপি এবং পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায় সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করাতে দেশে তীব্র লোডশেডিং হয়। এতে করে দায়িত্ব নেয়ার এক বছরের মাথায় সরকার বিপাকে পড়ে। অর্থমন্ত্রী তার ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় স্বীকার করেন, গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতের উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করতে পারেনি তার সরকার। এ জন্য তিনি বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতাকে দায়ী করেন। ওই সময় সরকার বাজেটের সঙ্গে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের একটি পথ নক্সা জাতির সামনে তুলে ধরেন। মূলত এই পথনকশা ধরেই দেশে দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বা বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিনা দরপত্রে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে ওঠে।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০-১১ অর্থবছরে এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ওই বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেট
ওই সময় বিশ্বমন্দার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পড়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে রিজার্ভ বাড়াতে বৈদেশিক ঋণগ্রহণের অব্যাহত প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরা হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৯০ কোটি ঢাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে জাতীয় সংসদে ওই বছর সেপ্টেম্বর বাজেট বাস্তবায়নের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদন দেয়ার সময় আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘২০১০-১১ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দিয়ে প্রায় ৩ দশমিক ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হতে পারে। আমি ইতোপূর্বে মহান সংসদকে অবহিত (ডিসেম্বর-২০১০) করেছিলাম যে, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে পারে। তবে, সরকার প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’
অর্থাৎ দুই অর্থবছর জুড়েই বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি না পাওয়াতে সরকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। তবে ওই সময় বিপুল পরিমাণ বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে। যাতে করে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। সরকার ২০১২ সালেই চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ব্যর্থ হয়।
২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট
২০১৪ সালের নির্বাচন প্রস্তুতির ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০১২-১৩ এর বাজেটে। বাজেট বাস্তবায়নের প্রথম প্রান্তিকের প্রতিবেদনে সরকার ২০০৯-১০-এর সঙ্গে ২০১২-১৩ তে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র দাঁড় করায়। এতে বলা হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছর হতে ২০১১-১২ তিন অর্থবছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ৪ হাজার থেকে বেড়ে হয় ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ডিসেম্বর, ২০১২ পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে নতুনভাবে সংযোজিত হয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে যেখানে রপ্তানি আয় ছিল ১১ হাজার ৭৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সময়ে রপ্তানি আয় হয় ১২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০১১-১২ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে প্রায় ৬ হাজার ৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্সের তুলনায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ সময়ে রেমিট্যান্স আসে ৭ হাজার ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডিসেম্বর-২০১১-এ ছিল ৯ হাজার ৬৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ডিসেম্বর-২০১২ শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭৫১ মিলিয়ন মার্কিন জলার।
মূল্যস্ফীতির হার ডিসেম্বর ২০১১ সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ; ডিসেম্বর ২০১২ শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৬ শতাংশ (পমেন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে)।
এই প্রতিবেদনে অর্থনীতি গতিশীল হওয়ার একটি আভাস মেলে। এরপরও তখন বিশ্বমন্দার রেশ না কাটার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াতে দেশ এবং বিশ্বে বাংলাদেশকে এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামকে সরাসারি সমর্থন দেয়াতে দেশে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজেটে মোট ব্যয়ের প্রাক্কলন ধরা হয় ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। ওই বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যয় ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট
২০১৪ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার বাজেট পেশ করে। এটি ওই মেয়াদে সরকারের সব শেষ বাজেট ছিল। ওই বছর ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়। তবে এক দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে বিএনপি এবং সমমনাদের আন্দোলনে সরকারকে খানিকটা বিপাকে পড়তে হয়। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগে দাতাদের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন শুরু হয়। সঙ্গত কারণে সস্তায় ঋণ পাওয়ার জায়গা সংকুচিত হয়। ওই বছর নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাজেটে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রথম ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে সরকার। নির্বাচনি বাজেট হওয়াতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকার অতিরিক্ত বরাদ্দ রেখেছে বলে যে প্রচারণা ছিল তা সত্যি নয়। ওই বছর এডিবি বরাদ্দ ছিল ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ তে যা ছিল ৫৫ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১১-১২ তে যা ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এডিবি বরাদ্দ বৃদ্ধির সাধারণ ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬২১ কোটি টাকার অনুন্নয়ন-ব্যয় নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বিপুল বিরোধিতার মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ; কিন্তু ২০১৪ এর নির্বাচন-পরবর্তী লাগাতার অররোধ আর সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও চালায় বিএনপি এবং বিরোধী পক্ষগুলো। বীভৎস পোড়া মানুষের হাহাকার আর মানুষের রক্ত ভেজা এক প্রান্তর মাড়িয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম বাজেট দিতে জাতীয় সংসদে যান আবুল মাল আবদুল মুহিত।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় ১ লাখ ৭০ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এই ব্যয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরের এডিবি বরাদ্দের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। সরকার যেখানে গত তিনটি বাজেটে এডিবি বরাদ্দ গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা করে বাড়িয়েছে সেখানে এক ধাক্কায় এডিবি বরাদ্দ বাড়িয়ে দেড়গুণ করা হয়।
তবে প্রথম প্রান্তিকে বাজেট বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে এসে জাতীয় সংসদে এক বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে ৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৬ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। ইহা মোটেই সন্তোষজনক নয়।’
২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট
সব মিলেয়ে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। বাজেটে এডিবি বরাদ্দ রাখা হয় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গেল অর্থবছরের তুলনায় যা ছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। যদিও সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর দেশে বিপুল পরিমাণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া ছাড়াও সারা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। ওই বছর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকার দাতা সংস্থার পাশাপাশি ওই সময় থেকে ভারত এবং চীনের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া শুরু করে। এই অর্থ মূলত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট
২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় ২ লাখ ২৯ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট
ওই অর্থবছরের বাজেটে সর্বমোট সরকারি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় ২৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা হ্রাস করে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি নির্ধারণ করা হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা থেকে কিছুটা হ্রাস করে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। এখানেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিপুল বিনিয়োগের বিষয়টি সামনে আসে। যদিও অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা (জিডিপির ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ)। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ বিবেচনায় নিয়ে বাজেটের আকার দাঁড়ায় প্রায় ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা (জিডিপির ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ)। অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা (জিডিপির ১১ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট
কোভিড ১৯-এর প্রভাবে সারা বিশ্বেই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে। কোভিডের মধ্যেও প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ করেনি সরকার। উল্টো করোনা মহামারি কাটিয়ে উঠতে প্রণোদনা এবং কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় ২১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লাখ ০১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা থেকে ৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা হ্রাস করে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে, কোভিড-১৯-এর কারণে স্বাস্থ্য খাতে এবং বিভিন্ন প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় সাশ্রয় করে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়ের প্রাক্কলন হ্রাস করা হয় ১১ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট
কোভিড ১৯-এর ধাক্কা সামলে সারা বিশ্বের দেশগুলো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হয়। বাংলাদেশেও সেই বিবেবেচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট নির্ধারণ করে। ওই বছর মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট
২০২১-২২ অর্থবছরে মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে সরকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার বা মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় মোট ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা; কিন্তু এপ্রিল পর্যন্ত ব্যয়ের সার্বিক অগ্রগতি বিবেচনায় সংশোধিত বাজেটে সরকারি ব্যয় ১৭ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা হ্রাস করে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা হতে কিছুটা কমিয়ে করে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট
ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ২০২৩-২৪ এর বাজেটে একটি লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়। ফলে বাজেটে নতুন এক স্বপ্ন দেখায় সরকার। প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলন করা হয় ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস হতে ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে