Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের পাগলামির একাল-সেকাল

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪

সাম্প্রতিক সময়ে উরুগুয়ে যে ব্র্যান্ডের ফুটবল খেলছে, তাতে কোপা আমেরিকা কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে নিয়ে ভয়-শঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত সে শঙ্কাই সত্যি হয়েছে—১৫ বারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরে সেমিফাইনালের আগেই দর্শক কাতারে ব্রাজিল। প্রায় আট হাজার মাইল দূরের শহর লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত ম্যাচ যে ঢাকায় ঢেউ তুলবে, তা অনুমেয় ছিল। আদতে তুললও।

৭ জুলাই সকাল থেকে বাংলাদেশি ফুটবলামোদীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফিড ছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের দখলে! ১০ জনের উরুগুয়ের বিপক্ষে শেষ ২১ (নির্ধারিত ১৬, অতিরিক্ত ৫) মিনিট গোল করতে না পারায় ক্ষুব্ধ ব্রাজিল সমর্থককুল। চূড়ান্ত হতাশার বিহঃপ্রকাশ শুটআউটে হারের পর। ব্রাজিল সমর্থকদের রোনাজারির শব্দগুচ্ছ হয়ে ভাসছিল; ছিল রাগ-ক্ষোভ মাখা পোস্ট। প্রবল প্রতিপক্ষের দুরবস্থায় আর্জেন্টিনা সমর্থকরা ছিল মজা নেওয়ার তালে—কেউ খোঁচা দিয়ে, কেউ নিয়েছে সান্ত্বনা দেওয়ার কৌশলে! দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের সর্বোচ্চ আসর ঘিরে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকরা এ যাত্রায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফিফা বিশ্বকাপ মৌসুমে কিন্তু লাতিন আমেরিকার দুই দেশকে ঘিরে বাঙালি কেবল ভার্চুয়াল জগতে আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভাসে না; বিষয়টা রীতিমতো জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কখনো সেটা পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছায়। সে পাগলামির কিছু চিত্রের সঙ্গে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ঘিরে উন্মাদনার নানা দিক সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করব।

উৎপত্তি
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে নিয়ে মাতামাতির উৎপত্তির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। একটা সময় সীমিত সংখ্যক মানুষ রেডিও-পেপার পত্রিকার মাধ্যমে বৈশ্বিক ক্রীড়াঙ্গনের খবরাখবর রাখত। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে ব্রাজিল। সংগত কারণেই ওই সময়ে বাংলাদেশি সমর্থকদের মাঝে ব্রাজিলের আধিপত্য ছিল। দেশে টেলিভিশনে খেলা দেখা শুরুর পর থেকেই লাতিন দুই দেশকে নিয়ে মাতামাতির সূত্রপাত বলেই ধারণা করা হয়। সেটা আশির দশকে। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে কর্মরত প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক দিলু খন্দকার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে ঘিরে উন্মাদনার সূত্রপাত সম্পর্কে বলছিলেন, ‘আমাদের আগের প্রজন্মে ব্রাজিলের সমর্থক বেশি ছিল, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। দিয়েগো ম্যারাডোনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছেন। কোনো খেলোয়াড় একক নৈপুণ্য দিয়ে বিশ্বকাপ জয় করতে পারেন—সেটা ম্যারাডোনা করে দেখিয়েছেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে কিন্তু একক নৈপুণ্য দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির দ্বিতীয়টি নেই। ম্যারাডোনার কারণেই বাংলাদেশে আর্জেন্টিনাকে ঘিরে উন্মাদনার সূত্রপাত। ম্যারাডোনা যে কাজটা করে গেছেন, সেটা টেনে নিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন মেসি।’

একক নৈপুণ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয় করা ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে ১৯৯০ সালের ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে পেনাল্টি গোলে জার্মানির কাছে ১-০ ব্যবধানে হেরে যায় আলবিসেলেস্তেরা। সে পেনাল্টি নিয়ে বিতর্ক আছে। আর্জেন্টিনার দুই ফুটবলারকে লাল কার্ড দেখিয়েছিলেন রেফারি এডগার্দো কোডেসাল। বিতর্ক আছে ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে প্রথম মার্চিং অর্ডারের সিদ্ধান্ত নিয়েও। বিতর্কিত বিষয়গুলো আবেগপ্রবণ বাংলাদেশি ফুটবলামোদীদের আহত করেছে। ওই ঘটনাগুলোই কি আর্জেন্টিনাকে সমর্থনে এ দেশের ফুটবলামোদীদের আরও বেশি প্রভাবিত করেছিল? প্রশ্নের জবাবে সাতটি ফুটবল বিশ্বকাপ কভার করা দিলু খন্দকার বলছিলেন, ‘হয়তো কিছুটা করেছিল। কিন্তু আমি মনে করি, বাংলাদেশি সমর্থকদের বেশি আকৃষ্ট করেছিল ম্যারাডেনার ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের অসাধারণ নৈপুণ্য।’

ব্রাজিলকে ঘিরে উন্মাদনার কারণ
আশি-নব্বই দশকে পাঠ্যবইয়ে ছিলেন কালো মানিক পেলে। তারও আগে রেডিও এবং পেপার-পত্রিকায় বৈশ্বিক ক্রীড়াঙ্গনের খবরাখবর রাখতেন বাংলাদেশের সীমিত সংখ্যক ক্রীড়ামোদী। পঞ্চাশ দশকের শেষদিক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের আধিপত্য ছিল। সেই আধিপত্যের কারণে বাংলাদেশের মানুষ ব্রাজিলকে সমর্থন করত বলে মনে করা হয়। পেলে, গারিঞ্চা, ভাভাদের মাধ্যমে শুরু হওয়া জনপ্রিয়তাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিলেন রোমারিও, রোনালদিনহো, রোনালদো, রিভালদোরা। উল্লিখিতরা টানা তিন (১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০২) বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে ব্রাজিলকে দুটি (১৯৯৪ ও ২০০২) শিরোপা এনে দেন, যা ওই সময়কার উঠতি বয়সীদের মনে ব্রাজিলপ্রীতির বীজ বুনে দিয়েছিল।

আর্জেন্টিনাকে ঘিরে উন্মাদনার কারণ
আশির দশকে এসে বাংলাদেশের মানুষ টেলিভিশনে খেলা দেখা শুরু করে। ১৯৭৮ সালের পর ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করে। ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালে অতিমানবীয় ম্যারাডোনাকে টিভি পর্দায় দেখেছিল বাংলাদেশের মানুষ। ডোপ পাপের কারণে নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপও খেলেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’ খ্যাত দিয়েগো ম্যারাডোনা। ব্রাজিলের জনপ্রিয়তার বিপরীতে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বলয় গড়ে ওঠা ম্যারাডেনার জাদুকরী ফুটবল দিয়ে, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে। পরে মেসি-ডি মারিয়ারা সেটা টেনে নিয়ে গেছেন। আর্জেন্টিনা ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে হারলেও ২০২২ সালে শিরোপা জয় করে। ২০০৪ থেকে ২০২১—কোপা আমেরিকার সাত আসরের মধ্যে পাঁচ ফাইনাল খেলেছে দেশটি। পঞ্চম প্রচেষ্টায় এসে শিরোপা স্বাদ পায় আলবিসেলেস্তেরা, সেটা প্রবল প্রতিপক্ষ ব্রাজিলকে হারিয়ে। ম্যারাডোনার কল্যাণে শুরু হওয়া উন্মাদনা ভালোভাবেই টেনে নিয়েছেন মেসিরা। এই প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীরা লিওনেল মেসির জাদুকরী পারফরম্যান্সে আকৃষ্ট হয়েই যে আর্জেন্টিনার সমর্থনে নিজেদের বিলিয়ে দেন, সেটা না বললেও চলে। দুই আর্জেন্টাইন ফুটবলশিল্পীর নিপুণ শৈলী যে বিশ্বব্যাপী আর্জেন্টিনার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় মূল অবদান এতে সন্দেহ নেই। আর দলগতভাবে সাম্প্রতিক সাফল্যের কারণে দেশটিকে নিয়ে উন্মাদনাও ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে, বিশেষ করে উদীয়মানদের মধ্যে।

উন্মাদনার চিত্র
দুই দেশের সমর্থকদের ঘিরে উৎসবে রঙিন হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। কাতার বিশ্বকাপ চলাকালে রীতিমতো খাসি-গরু কেটে ভোজের আয়োজনও করা হয়েছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ পতাকা টানানোর খবর তো বেশ পুরোনো। গত কয়েক বিশ্বকাপে এমনটা নিয়মিত দেখা গেছে। ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসার টানে বাড়ির রংও দেশ দুটির জাতীয় পতাকার রঙে রাঙাতে দেখা যাচ্ছে নিয়মিত। দুই দেশের পতাকার রঙের রিকশা, নৌকার মতো যানবাহনও সাজাতে দেখা গেছে। বিশ্বকাপ মৌসুমে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় উৎসবটা বোধকরি ‘পতাকা উৎসব’। বিভিন্ন দেশের পতাকা ও জার্সিকে ঘিরে মৌসুমি ব্যবসাও জমজমাট হয়ে ওঠে। এ সময় বিভিন্ন অঞ্চলে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের মাঝে প্রীতি ম্যাচও হয়ে থাকে।

বৈচিত্র্য
সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ব্রাজিলের কাতার বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয়েছিল। রাতে ম্যাচ শুরুর আগে ২৪ নভেম্বর জামালপুরের মাদারগঞ্জে আনন্দ শোভাযাত্রা করেছে জার্সি পরিহিত ব্রাজিলের সমর্থকরা! ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ চলাকালে ঢাকার রাস্তায় আর্জেন্টিনার পতাকায় সজ্জিত রিকশা নিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়ে আবু তাহের; যে নিজেই নিজের ডাক নাম রেখেছিল মেসি। আবু তাহের মেসির ঘোষণা ছিল, ‘ব্রাজিল সমর্থকদের আমার রিকশায় ওঠার সুযোগ নেই।’ দুই দেশের সমর্থনে দেশের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি নাটক-সিনেমায় বিষয়টি উঠে আসে।

ফুটবল উৎসব থেকে পাগলামি
লাতিন আমেরিকার দুই দেশকে ঘিরে উন্মাদনার ঢেউ ওঠে চার বছর পর, ফুটবল বিশ্বকাপের সময়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাতিন দুই দেশের ফুটবলকে ঘিরে উন্মাদনা অবশ্য আশঙ্কাও জাগাচ্ছে। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ চলাকালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে লালমনিরহাটে এক হোটেল শ্রমিক মারা যায়। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ শুরুর আগেই নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ধারালো অস্ত্র নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল দুদলের সমর্থকরা। উঁচু স্থানে প্রিয় দলের পতাকা টানাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে মৃত্যুর একাধিক ঘটনা আছে। বিশ্বকাপ মৌসুমের এ উন্মাদনা ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার সময়ও দেখা গেছে। আসরের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। ফাইনালের আগেই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। যে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের আগেই জড়ো হয়ে একসঙ্গে খেলা দেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তার আগে, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ মৌসুমে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সংঘর্ষে বরিশালে ১১ জন আহত হয়েছিল।

সমর্থকরা যখন বিশ্ব গণমাধ্যমে
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুদলের সমর্থকদের পাগলামির চিত্র দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কাতার বিশ্বকাপ চলাকালে দেশের এ উন্মাদনা বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। বড় পর্দায় দেখানো ম্যাচকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণস্রোতের চিত্র ফলাও করে ছাপা হয়েছে, প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে আর্জেন্টিনার সমর্থন বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। আলবিসেলেস্তেদের সমর্থনের চিত্র দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরের আর্জেন্টিনায়, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন রূপ দিয়েছে।

আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশ প্রীতি
বাংলাদেশিদের আর্জেন্টিনা প্রীতি দেশটির নাগরিকদেরও আকৃষ্ট করেছে। যে কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থনে অনেক আর্জেন্টাইনকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব দেখা যায়। দুই দেশের সম্পর্কের সূত্রধরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকে উড়িয়ে নিয়েছিল আর্জেন্টিনার ক্লাব সোল দে মায়ো। যদিও সে সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নিতে সময় লাগেনি।

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ