রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ পুলিশ চায় জনগণ
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, আইনের প্রতি অনুগত এবং নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী চান পুলিশ সংস্কার কমিশনের জনমত জরিপে অংশ নেয়া সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী চান রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ, যেখানে ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ চান আইনের প্রতি অনুগত এবং নিরপেক্ষ পুলিশ চায়। অন্যদিকে ৮৪ শতাংশ মতামত এসেছে দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ গঠনের আর ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ এসেছে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রচলনের।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশ পুলিশকে নতুন করে গড়ে তোলার এখনই সময়। এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা গেলে এই বাহিনী জনবান্ধব হয়ে উঠবে, যা শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ সমাজ গঠনে পথিকৃৎ হবে। ৩ অক্টোবর গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন ৩০ অক্টোবর ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে জরিপের প্রজ্ঞাপন দেয়। মতামত প্রদানে বেঁধে দেয়া ১৬ দিনে জরিপে অংশ নেন ২৪ হাজার ৪৪২ জন।
গত মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত জরিপের ফলাফল বলছে, পুলিশ প্রবিধানমালার পাশাপাশি ফৌজদারি কার্যবিধিতে পড়া পুলিশি কার্যক্রমের অনেক বিধি সংস্কার বা পরিবর্তন চান অংশগ্রহণকারীরা। এ লক্ষ্যে পুলিশ আইন এবং বিধি-বিধান বদলে যুগোপযোগী করতে ও জবাবদিহি নিশ্চিতে অভিযোগ কমিশন গঠন, গায়েবি বা ভুয়া মামলা রোধ, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার প্রতিরোধ এবং সাদা পোশাকে তুলে নেয়া প্রতিরোধে ৫৪ ধারাসহ ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংস্কারের পক্ষে মতামত এসেছে।
সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে তুলে নেয়ার এই ধারা বন্ধে জরুরি কল সার্ভিস চালু, আটকের সময় বিশেষত সন্ধ্যার পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইউনিফর্ম পরা এবং ইউনিফর্মে ডিপিএস ট্রাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইস স্থাপন (body-worn camera) বাধ্যতামূলক করা এবং আটকের সময় ম্যাজিস্ট্রেট অথবা জনপ্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিতেরও পক্ষে অংশগ্রহণকারীরা।
অন্যদিকে এফআইআর রুজুর সময়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ক্ষমতার আইনগত দিক, এফআইআর বহির্ভূত কাউকে মামলাভুক্ত করতে তদন্ত কর্মকর্তাকে কেস ডায়েরি পেশের বাধ্যবাধকতা এবং ভুয়া মামলা দিলে মামলাকারীর বিপক্ষে আইনগত ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মতামত এসেছে। এ ছাড়া রিমান্ডে কাঁচ দিয়ে ঘেরা ঘরে এবং নারী আসামিকে নারী কনস্টেবলের সামনে জিজ্ঞাসাবাদসহ এ-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের পক্ষে সাধারণ মানুষ।
পুলিশের দুর্নীতি এবং অপরাধ তদন্তে সম্পূর্ণ স্বাধীন সংগঠন, সাবেক বিচারপতির অধীনে কমিশন গড়া বা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দিয়ে সংশ্লিষ্ট ধারা সংস্কার করে এ কমিশনে ক্ষমতা অর্পণের পক্ষেও মতামত উঠে এসেছে।
জনবান্ধব, দক্ষ পুলিশ গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য
মানবাধিকারকর্মী এবং গুম কমিশনের সদস্য মো. নূর খান লিটন বলেন, দুর্নীতিমুক্ত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, আইনের প্রতি অনুগত এবং নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা গেলে এই বাহিনী এমনিতেই জনবান্ধব হয়ে উঠবে, যা জনমতেও উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, জরিপে পুলিশ সংস্কারের পাশাপাশি কোথায় কোথায় পরিবর্তন করতে হবে, তাও উঠে এসেছে। পুলিশ আইনের সঙ্গে সিআরপিসি সংস্কার, পরিমার্জন, সংযোজনের কথাও বলা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় যে, জনবান্ধব, দক্ষ পুলিশ জনগণের কাছে কতটা কাঙ্ক্ষিত। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম জরিপে আসা মতামতকে এই সময়ের চাহিদা উল্লেখ করে বলেন, ‘অনেক সুপারিশ আমাদের সংগঠনের দেয়া প্রস্তাবনায়ও আছে।’
তিনি বলেন, পুলিশকে অবশ্যই জনবান্ধব করতে হবে। পুলিশ কর্মকর্তা বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন স্মরণে নিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশকে প্রাণঘাতী রাইফেল বা কোনো ধরনের মারণাস্ত্র দেয়া যাবে না। আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার করলে শাস্তির বিধান রাখতে হবে। কনস্টেবলদের নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ নেয়ার আগে রাইফেল হাতে দেয়া যাবে না। পুলিশের শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীকে মোকাবিলায় পুলিশের স্পেশাল আর্মড ফোর্স বা বিশেষ ইউনিট থাকতে পারে।’
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. নাজমুল হক বলেন, ১৮৬১ সালের আইন দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত হয়। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন এবং ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধান দিয়ে দৈনন্দিন কাজ করেন পুলিশ সদস্যরা; কিন্তু ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই আইনগুলো ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থরক্ষা ও দেশি মানুষকে নিয়ন্ত্রণে তৈরি। তাই জনবান্ধব পুলিশ গড়তে আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার খুব দরকার, যেটি জরিপেও প্রতিফলিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশ যদি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারে, তবে তারা নিজেদের কাজে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন কেন করতে পারছেন না? উত্তর খুব সহজ। সমস্যাটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের। আধুনিক পুলিশ গঠনের সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, তখন এ বাহিনীকের সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সুযোগ দিতে হবে।’
‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থাও রাখা দরকার’- বলেন মো. নাজমুল হক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে