Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

শেষ পর্ব

শখের বশে পুকুরে ইলিশ চাষ করা যাবে

Dr. Md. Anisur Rahman

ড. মো. আনিছুর রহমান

রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪

প্রথম পর্বের পর:

ইলিশ গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবেই দেশব্যাপী পরিচিত ড. মো. আনিছুর রহমান। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহের অর্থ ও প্রশাসন বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা নদীকেন্দ্র, চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে তিনি এলপিআরএ আছেন। এর আগে তিনি ইলিশ গবেষণায় এবং জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর পরিকল্পণায় ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ইলিশ কেন বাঙালি সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠল এবং তা রক্ষার্থে আমাদের করণীয় কী- এ বিষয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কে এম জাহিদ। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ পড়ুন শেষ পর্ব।

ভিউজ বাংলাদেশ: গবেষণায় দেখা গেছে, নদীতে আর ইলিশ আসছে না। নদী বা মোহনায় ইলিশের উৎপাদন কম হওয়ার পেছনের কারণ কী?

ড. আনিছুর রহমান: দেখুন দেশে ইলিশের উৎপাদন দিনকে দিন বাড়ছে। তবে কিছু কিছু সময় দেখা যাচ্ছে নদী বা মোহনায় আগের মতো আর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এর সত্যতা কিছুটা আছে। তবে, সমুদ্রে ভালোই ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ শহর-নগর ও শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেছে নদীর ধারে। এই নগর-শহরের কারণেই সব নদী দূষিত হচ্ছে। এই নগর-শহরগুলো নদীতে যে পরিমাণ পয়ঃনিষ্কাষণ ফেলছে, কলকারখানার বিষাক্ত রঙ ও বর্জ্য ফেলছে, তাতে নদীগুলো যে পরিমাণে দূষিত হচ্ছে, তাতে শুধু ইলিশই না, যে কোনো ধরনের মাছ এবং জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদারাজি ধ্বংসের সম্মুখীন। তাতে নদীর জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে।

তাই কলকারখানার ব্যবহৃত পানি নদীতে বা বাইরে ফেলার আগে তা ইটিপির মাধম্যে শোধন করে ফেলতে হবে। বাস্তাবে কি তা হচ্ছে? হচ্ছে না। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হলো যত বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি, ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে নদীকে বাঁচাতে হবে। নদীর মাছ জলজপ্রাণী ও জলজ উদ্ভিদারাজিও বাঁচাতে হবে। সঙ্গে নদীগুলো দখলমুক্তও করতে হবে। নদী থেকে বালু উত্তোলন কমাতে হবে। তা না হলে শুধু ইলিশ নয়, সব মাছ ও জলজপ্রাণীই আমরা হারাব।

ভিউজ বাংলাদেশ: ইলিশেকে কেন রহস্যময় মাছ বলা হচ্ছে? আবার পুরুষ-প্রজাতির ইলিশকে বলা হচ্ছে আরও রহস্যময়। এর কারণ কী? নারী ও পুরুষ ইলিশ চেনার উপায়ই বা কী? ইলিশ কি যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়?

ড. আনিছুর রহমান: মানুষ তো সুন্দরের পূজারি। সব সুন্দরের দিকেই মানুষের দৃষ্টি থাকে। তেমনি বাজারে গেলে সুন্দর মাছের দিকেই সবার দৃষ্টি পড়ে। ইলিশের ব্যাপারে আসলেই মজার একটি ব্যাপার আছে, একেকটি বাল্কে বা দলে যতগুলো ইলিশ ধরা পড়ে, তার মধ্যে শতকরা কতভাগ পুরুষ ও কতভাগ স্ত্রী তার পরিমাণ বা সংখ্যার পার্থক্য পাওয়া যায় বয়স ভেদে, আকার ভেদে ও স্থান ভেদে।
আমাদের পদ্মা ও মেঘনা বেয়ে ইলিশ যত উপরে উঠে আসে, সেগুলো আকারে ছোট থাকে। আর সেগুলোর ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে এই জাতীয় ইলিশের ঝাঁকে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ পুরুষ আর ৪০ ভাগ স্ত্রী দেখা যায়। আর তা যখন পদ্মা হয়ে চাঁদপুরে মেঘনায় এসে জড়ো হতে থাকে, তখন তাদের আকার প্রায় ২৪-২৮ সেন্টিমিটার হয়। শতকরা ৫০ ভাগ বা কাছাকাছি রেসিওতে পাওয়া যায়।

কিন্তু ইলিশ যখন ডিম পাড়তে সাগর-তীরবর্তী নদীর মোহনায় আসে, তখন তার অনুপাত দাঁড়ায় শতকরা ৮০-৯০ ভাগ স্ত্রী ইলিশ। অর্থাৎ আকার বড় হচ্ছে আর পুরুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হলো ৫০ বা ৬০ ভাগ পুরুষসমৃদ্ধ ইলিশ মাছের দলের পুরুষ ইলিশ গেল কোথায়? এটাই হলো পুরুষ ইলিশের রহস্য। মজার বিষয় হলো বয়ঃসন্ধিক্ষণে টেনুয়ালোসা ইলশা জাতের পুরুষ ইলিশ ও টেনুয়ালোসা টলি জাতের পুরুষ ইলিশগুলো তাদের চরিত্র বা যৌনতা পরিবর্তন করতে পারে। পুরুষ আকারে একটু লম্বা হয়, উজ্জ্বলতার দিকে থেকেও কম বা ধূসর হয়। স্ত্রী ইলিশ মোটা তাজা ও উজ্বলতা সম্পন্ন হয়। পুরুষরা যৌনকার্য করে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে যায় বা জালে ধরা পড়ে যায়, সে জন্যও তাদের দলে তেমন দেখা যায় না। তবে বেশির ভাগ পুরুষই তাদের চরিত্র বদল করে ফেলে নিজেকে স্ত্রী ইলিশের মতো সুন্দরী হওয়ার জন্য।

ভিউজ বাংলাদেশ: পুরুষ ইলিশ তো বাজারেও দেখা যায় না। তাহলে জালে ধরা পড়া এত পুরুষ ইলিশ যায় কোথায়?

ড. আনিছুর রহমান: পুরুষ ইলিশ নদীর ঘূর্ণায়মান জলরাশিতে শুক্রাণু ছাড়ার পর এবং স্ত্রী ইলিশও একই পানিতে ডিম ছাড়ার পর উভয় প্রকারের ইলিশকেই দেখতে লম্বাটে, সরু, রুগণ অনুজ্জ্বল ও অসুন্দর লাগে। জেলেদের জালে এই মাছ যদি ধরা পড়ে, তখন তারা এগুলো আর বাজারে নিয়ে আসে না। তাহলে সেগুলো তারা কি করে? অল্প হলে জেলেরা তা খেয়ে ফেলে বা অন্যদের দিয়ে দেয়। আর বেশি হলে সেগুলো তারা নোনা ইলিশ বানায়। যা আমরা সারা বছর বাজারে দেখতে পাই।

ভিউজ বাংলাদেশ: চাঁদপুরকেই শুধু ইলিশের বাড়ি বলা হয়? আসলে ইলিশের বাড়ি কোথায়?

ড. আনিছুর রহমান: ইলিশ আসলে বাংলাদেশি পতাকাবাহী পণ্য। অনেকেই বলে, স্যার, আপনি তো বহুদিন চাঁদপুরে থাকলেন, ইলিশ তো চাঁদপুরেই পাওয়া যায়। এখানকার ইলিশ খুবই সুস্বাদু। তখন আমি বলি হ্যাঁ, চাঁদপুরেও ইলিশ পাওয়া যায়। আর চাঁদপুরেরও ইলিশ ভালো ও সুস্বাদু। আসলে আমি বলতে চাই, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মতো চাঁদপুর জেলাতেও ইলিশ পাওয়া য়ায়। এখানেও ইলিশ ডিম ছাড়ে, বড় হয় এবং এখানকার জেলেরাও মাছ ধরে। এই মাছ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পাওয়া যায় বটে, এত সুন্দর ও এত সুস্বাদু ইলিশ মাছ শুধু বাংলাদেশই পাওয়া যায়। কারণ বাংলাদেশের নদীর জল ও আবহাওয়া ও অববাহিকা ইলিশ পছন্দ করে বসতি গড়ে তুলেছে। তাই আমি বলি ইলিশের বাড়ি কোনো সংকীর্ণ জেলা বা স্থানে নয়, ইলিশের বাড়ি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জলসীমা।

ভিউজ বাংলাদেশ: কথায় বলে ইলিশ আড়াই প্যাঁচে মরে? আসলে ইলিশ ধরে উপরে উঠাতেই খুব দ্রুত কেন মরে?


ড. আনিছুর রহমান: হ্যাঁ, আপনি সঠিক প্রশ্নই করেছেন। ইলিশ কতক্ষণ বাঁচে ডাঙ্গায়? আড়াই লাফে ইলিশ মরে বলে বহুল প্রচলিত কথাটির সত্যতা আছে, তবে পুরোপুরি ঠিক না। আমি এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, গবেষণা করে দেখেছি, ইলিশ মাছ বাঁচার জন্য হাই-অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। পানি থেকে ইলিশ তুলে আনার পর আমি যখন দেখেছি, তারা খুব কাতরাচ্ছে, খুবই কাহিল বা ক্লান্ত হয়ে গেছে, তখন আমি পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট যুক্ত পানিতে তাদের ছেড়ে দিয়ে দেখেছি, এই পানি পেয়ে ওরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভরা বালটি বা গামলায় তারা আট দশ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তা ছটফটানি থেকে যেন রেহাই পেলো তারা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, ইলিশ মাছ বাঁচার জন্য বেশি পরিমাণে অক্সিজেন দরকার হয়। আমাদের দেশি কই, শিংয়ের মতো ডাঙ্গায় প্রাপ্ত কম অক্সিজেনে তারা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। কারণ দেশি বা অন্যান্য মাছের ইয়ার ব্রিদিং অর্গান অর্থাৎ আমরা যাকে ফুলকা বলি, সেগুলো আছে। আর সেগুলো ব্যবহার করে তারা দীর্ঘক্ষণ পানির বাইরেও টিকতে পারে।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি যখন বললেনই পুকুরে ইলিশ চাষের চেষ্টা করেছেন। তাহলে পুকুরে কি ইলিশ চাষ সম্ভব? গবেষণা ও বাস্তবতা কী?


ড. আনিছুর রহমান: পুকুরে ইলিশ চাষ করা সম্ভব। তবে তা বাণিজ্যিকভাবে নয়। শখের বশে পুকুরে ইলিশের চাষ করা যাবে। ১৯৮৮ সালে চাঁদপুরের মৎস্য ইনস্টিটিউটের ২টি পুকুরে ইলিশ চাষের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই দুটি পুকুরে বছরের মার্চ থেকে ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২ মাস ধরে পুকুরে ইলিশ মাছের চাষ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। ওই গবেষণার ফলে ইলিশের বেঁচে থাকার হার ছিল শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ। ২০১০ সালে তিনটি পুকুরে আবার ইলিশ চাষ শুরু করে। সেখানে ১০ ফুট গভীরতার ১টি, ৮ ফুট গভীরতার ১টি ও ৬ ফুট গভীরতার আরও একটি মোট ৩টি পুকুরে প্রায় ২ হাজার ২শত ইলিশপোনা ছাড়া হয়।

কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহ করে নদীর স্রোত সৃষ্টি, ইলিশের জন্য উপযোগী খাবার সরবরাহ করে জাটকাগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হয়। ওই সব জাটকা প্রথম বছরে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত বাড়ে, কিন্তু বেশ কিছুদিন অবজার্ভ করে দেখা যায়, তারা বাড়ছে না মোটাও হচ্ছে। এ গবেষণা আরও কিছুদিন চালিয়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে আমরা নিশ্চিত হই, বাণিজ্যিকভাবে পুকুরে ইলিশ চাষ সম্ভব নয়। পুকুরে খাদ্য ও স্রোত দিয়ে ইলিশকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলেও আমরা দেখেছি এর স্বাদ, বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার নদীর মাছের মতো হয় না। সুতরাং সাগর-নদী ও নদীর মোহনাকেই মনে মনে আমরা পুকুর ভেবে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রূপে পালন করলেই মিটবে পুকুরে ইলিশ চাষের আশা।

ভিউজ বাংলাদেশ: ইলিশ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার এই জীবনে ইলিশের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী? ইলিশ খেতে গেলে আপনার কেমন লাগে?

ড. আনিছুর রহমান: কেউ কোথাও যদি ইংলিশ বলে সেখানে আমি শুনি ইলিশ। এমনকি পুলিশ বললেও আমি শুনি ইলিশ। তো বুঝতেই পারছেন আমার মননে-মগজে কী ধারণ করে! দীর্ঘ ৩৩ বছর ইলিশের সঙ্গে আমার ঘর-সংসার বসবাস। গবেষণার সময় আমি যখন ইলিশ ধরি বা নাড়ি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, তখন মনে হয় ইলিশের সঙ্গে আমি কথা বলছি। আমি এখন এলপিআরে আছি। চাকরি বা ইলিশ গবেষণা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে এলেও আমাকে ইলিশ ছাড়েনি। এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক গবেষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষকরা ইলিশ বিষয়ে গবেষণার তথ্য জানতে ফোন দেয় বা যোগাযোগ করে।

এ ছাড়া ইলিশ বিষয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা রাষ্ট্রীয় কোনো মিটিংয়েও ডাক পড়ে। অর্থাৎ এখনো আমি ইলিশ নিয়েই আছি। এটা ভালো লাগে। আগে এই ইলিশপ্রীতি বা পাগলামির জন্য আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা অভিযোগ করত যে, আমি সারাজীবন তাদের সময় দেইনি, আমি শুধু ইলিশ ইলিশ করেই জীবন পার করলাম। কিন্তু এখন এই সময়ে এসে যখন তারা দেখে বাজারে বড় বড় ইলিশ, আর বাঙালিরা তা খেতে পাচ্ছে, ইলিশ নিয়ে আমাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা দিন দিন বাড়ছে, ইলিশ জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে তখন তারা আনন্দিত হয়। সর্বোপরি তারা যখন দেখছে ইলিশ কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী মাছ, তখন তারা আর আমাকে অভিযোগ করে না। বরং আমাকে নিয়ে তারা গর্ববোধই করে।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ


ড. আনিছুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ


প্রথম পর্ব:
পেলেপুষে ইলিশকে আমাদের জলসীমায় রাখতে হবে

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ