মেট্রোরেল কি আমাদের শৃঙ্খলা শেখাতে পারবে?
জাতি হিসেবে আমাদের বিশৃঙ্খলার কাহিনি কম নয়। এমন কী বিদেশি বিমানবন্দরগুলোতেও আমাদের এই বিশৃঙ্খলা দৃশ্যমান হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করতে যান, এই বিশৃঙ্খলাকে তারা হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করেন। মাঝে মাঝেই না কি তারা লাইন ছেড়ে বেরিয়ে যান। তাদের লাইনে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হয়।
আমরা যে লাইনে দাঁড়াতে পারি না, এটা আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা। এই লাইনচ্যুত হওয়ার স্বভাবই আমাদের জাতিগত বিশৃঙ্খলাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাস্তাঘাটে বেরুলেই আমাদের বিশৃঙ্খলার হাজারটা নিদর্শন চোখে পড়ে। রাজপথেও গাড়ি চলছে, যার যার খুশি মতো। যে গলিতে ওভারটেক নিষিদ্ধ সে গলিতেও একটা গাড়ি আরেকটা গাড়িকে পার হয়ে যেতে চায়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ জ্যামের কারণই বিশৃঙ্খলা।
কোনো এক বাঙালি লেখক লিখেছিলেন, বাঙালি প্রথম লাইনে দাঁড়াতে শিখেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেশন নিতে গিয়ে। এর আগে বাঙালির লাইনে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। গ্রামীণ সমাজ-ব্যবস্থায় যে যার মতো ছুটেছে। ক্ষেতে গিয়ে কাজ করেছে, নদীতে গিয়ে মাছ ধরেছে। ব্যাংকে গিয়ে যে লাইনে দাঁড়াতে হয়, এটা বাঙালি শিখেছে এই হাল আমলে।
শুধু ব্যাংকে না, নগরজীবনে অনেক কিছুতেই এখন আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হয়। নানারকম বিল পরিশোধ থেকে শুরু করে শপিংমল, ডাক্তার চেম্বারে বাধ্য হয়েই লাইনে দাঁড়াতে হয়। সুপারশপেও লাইনে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি শুরু হয়ে গেছে। অধুনা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল।
টিকিট কাটা থেকে শুরু করে কার্ড পাঞ্চ, সিঁড়িতে, মেট্রোরেলে ওঠা-নামা প্রতিটি পদক্ষেপেই মিলিটারি স্টাইলের সুশৃঙ্খলার পরিচয় দিতে হয়। যারা ইতোমধ্যে মেট্রোরেলে ভ্রমণ করেছেন, তারা জানেন। কেউ একটু নিয়মের ব্যত্যয় করলেই অন্যরা তার দিকে বাঁকা চোখে তাকান। যার মানে, ‘ওরে ক্ষ্যাত, এখনো মেট্রোরেলে চড়া শেখো নাই! দেখো, আমি কেমন ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে আসছি’!
সিস্টেমের আধুনিকীকরণের কারণেই হোক, অন্য যে কোনো কারণেই হোক, মেট্রোরেলে সবাইকে সুশৃঙ্খলার নির্দেশনা মেনে চলতে দেখা যায়। টিকিট কাউন্টারের সামনে তো সবাইকে বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়াতেই হয়, ট্রেন আসার আগে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে হলেও সবাই দরজা খোলার জায়গার সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রত্যেক যাত্রী সুশৃঙ্খলভাবে ওঠেন-নামেন।
অনেক সময় মেট্রোরেলে লোকাল বাসের চেয়ে ভিড় বেশি হলেও কোনোরকম হুড়োহুড়ি চোখে পড়ে না। মেট্রোরেলের ওই একই যাত্রী মতিঝিল নেমে লোকাল বাসে উঠতে গেলে হয়তো অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করতে বাধ্য হবেন। এর কারণ স্বভাবদোষ নয়। দোষটা আসলে ব্যবস্থাপনার।
লোকাল বাসের যাত্রী জানেন না একটা বাস মিস করলে আরেকটা বাসে তিনি উঠতে পারবেন কি না। তার গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া আছে। বাসে উঠতে পারলেও সেই বাস কখন গন্তেব্যে পৌঁছাবে সে ব্যাপারেও তিনি অনিশ্চিত। ফলে সারাক্ষণই তাকে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। এই উদ্বিগ্নতা অনেক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনাকে উসকে দেয়। ঢাকা শহরে গণপরিবহনে যারা যাতায়াত করেন, এই অভিজ্ঞতা তাদের সবারই আছে। শুধু ঢাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা আমাদের মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ও ২০০৫ সালে সর্বশেষ যে জাতীয় সমীক্ষা দুটি হয়েছে, তার ফল অনুযায়ী দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে অন্তত একজন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, যার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন। এহেন অবস্থায় মেট্রোরেল আমাদের নাগরিক জীবনে কেবল যাতায়াতের সুব্যবস্থাই নিয়ে আসেনি, মানসিক রোগ নিরাময়ের কেন্দ্র হয়ে এসেছে। মেট্রোরেল আমাদের সংস্কৃতিতে, মনে-মগজে, স্বভাবে, চেতনায় একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে আশা করা যায়।
মেট্রোরেল আমাদের কিছু শৃঙ্খলা শেখাবে। শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত করবে; কিন্তু সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন না হলে তার প্রভাব আমাদের স্বভাবে আর কতটা পড়বে!
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে