বালুচিস্তানের বিদ্রোহ কী পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারবে
বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান সফলভাবে শেষ করেছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। গোষ্ঠীটি বালুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন ছিনতাই করে। সেখানে জিম্মি প্রায় ৪০০ জন যাত্রীর ৩৪৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। কুয়েটা থেকে পেশাওয়ার যাওয়ার পথে সিবি শহরের কাছে ট্রেনটি হামলার শিকার হয়। এ হামলার দায়ও দাবি করে বিএলএ। একদিনেরও বেশি সময় ধরে সংঘাতের পর নিরাপত্তা বাহিনী ৩৩ জন হামলাকারীকে হত্যা করে। তবে ২১ জন যাত্রী এবং চারজন আধা-সামরিক সদস্যের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে।
বিএলএ বালুচ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি জানিয়েছিল; কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সরকারি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কিন্তু উন্নয়নবঞ্চিত প্রদেশ বালুচিস্তানে সহিংসতা বেড়েছে এবং বিএলএ উন্নত অস্ত্র ও স্থানীয় সমর্থনে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানসহ বিশ্বজুড়ে ট্রেন ছিনতাইয়ের ঘটনা অত্যন্ত বিরল। হামলাটি পাকিস্তানে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ ট্রেন ছিনতাই হিসেবেও চিহ্নিত। ঐতিহাসিকভাবে, এমন ঘটনা অস্বাভাবিক। ১৯২৩ সালে চীন এবং ১৯৭০-এর দশকে নেদারল্যান্ডসে ট্রেন ছিনতাইয়ের এমন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে। বিএলএর এমন বড় অপারেশন সফলভাবে সম্পাদনের ক্ষমতা তাদের ক্রমবর্ধমান সামরিক উৎকর্ষ এবং সাহসিকতাকেও তুলে ধরে।
নিরাপত্তা বাহিনী, অবকাঠামো এবং বিদেশি বিনিয়োগ, বিশেষ করে চীনের বহু-বিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সংযুক্ত প্রকল্পগুলোতে ক্রমশ হামলা করে আসছে বিএলএ। এই ট্রেন সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি একাধিক হামলার ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। আগেরগুলোর মধ্যে চীনা নাগরিক এবং সরকারি স্থাপনায় হামলাও রয়েছে।
বালুচিস্তান অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাত তীব্র হচ্ছে। বিএলএ’র সাম্প্রতিক সহিংসতার বেশিরভাগই বালুচিস্তানে চীনা বিনিয়োগ, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপেক) সংযুক্ত প্রকল্পগুলোকে লক্ষ্য করে। গোয়াদার গভীর সমুদ্রবন্দর এবং বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, যেখানে মিলিট্যান্টরা চীনা প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও আকস্মিক আক্রমণ পরিচালনা করেছে। বিএলএ এই প্রকল্পগুলোকে ‘ঔপনিবেশিক’ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে দেখে, যা স্থানীয় জনগণকে দরিদ্র রেখে বাইরের লোকদের লাভবান করে।
করাচি, কোয়েটা এবং গোয়াদারে চীনা নাগরিকদের ওপর হামলায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ বেড়েছে বেইজিংয়েরও যা ইসলামাবাদকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আরও জোর প্রচেষ্টা চালাতে বাধ্য করছে।
চলমান পরিস্থিতি নানা বিষয়ে একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। এর মধ্যে রয়েছে বালুচ বিদ্রোহের কারণ, বালুচিস্তানে অসন্তোষ বাড়াতে পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী এলিটদের ভূমিকা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ, বিএলএর ক্রমবর্ধমান সামর্থ্য ও সাহসিকতা এবং বালুচ অস্থিরতার কৌশলগত প্রভাব।
পাকিস্তানে চলমান বালুচ বিদ্রোহ হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত-জাতীয়তাবাদী সংঘাত। এর ঐতিহাসিক শিকড় এবং সুদূরপ্রসারী আঞ্চলিক প্রভাব রয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে বালুচ বিদ্রোহীরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে নিম্নস্তরের বিদ্রোহে জড়িত। অর্থনৈতিক প্রান্তিকীকরণ, জাতিগত অসন্তোষ এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি। বালুচ বিদ্রোহ পাকিস্তানের অন্য সশস্ত্র সংঘাতগুলো থেকে আলাদা। কারণ, এটি ধর্মীয় চরমপন্থায় নয়, বরং জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষায় পরিচালিত। পাকিস্তানি তালিবানের মতো ধমীয় চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিপরীতে বিএলএ এবং অন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে স্বাধীন বেলুচিস্তান দাবি করে।
তবে আন্দোলনটি এখনো বিভক্ত, যেখানে একাধিক গোষ্ঠী পাকিস্তানজুড়ে সক্রিয় এবং ইরান ও আফগানিস্তান তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসলামাবাদ বারবার তেহরান ও কাবুলের বিরুদ্ধে বেলুচ বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ এনেছে, যা আঞ্চলিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তম, পশ্চিম সীমান্তবতী এবং সবচেয়ে কম জনবহুল প্রদেশ। যদিও এটি দেশের মোট আয়তনের ৪৪ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত। দেশের ২৪ কোটি নাগরিকের মাত্র এক কোটি ৪৮ লাখ এখানে বাস করে। বেলুচিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষের কেন্দ্রস্থল। প্রদেশটি প্রতিবেশী ইরান এবং আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে জাতিগত বেলুচ সম্প্রদায়ের বসবাস। এই সীমান্ত-অতিক্রমী জাতিগত উপস্থিতি চলমান অস্থিতিশীলতায় অবদান রেখেছে। সম্প্রতি ইরান এবং পাকিস্তান উভয়ই একে অন্যের অঞ্চলে সক্রিয় থাকার অভিযোগে চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই উত্তেজনা চলমান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতিগুলো উপজাতীয় বিভাজনকে তীব্র করে এবং অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার জন্য মূলত দায়ী। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর বেলুচ নেতারা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছিলেন; কিন্তু তাদের দমন করা হয়। ১৯৫৫ সালের ‘এক ইউনিট’ পরিকল্পনা পাকিস্তানের প্রভাবশালী প্রদেশ পাঞ্জাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে বেলুচদের আরও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বেলুচিস্তানের পাকিস্তানের ফেডারেল শাসন পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বের অভাব, সম্পদ শোষণ এবং ঔপনিবেশিক অতীতের শিকড়যুক্ত নীতির শিকার। স্থায়ী শান্তির জন্য দমন থেকে সমঝোতার দিকে পরিবর্তন প্রয়োজন, যেখানে অর্থবহ আস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক সংলাপ অঞ্চলের মূল অসন্তোষ মোকাবিলায় অপরিহার্য।
২০০৪ সালে চীনের অর্থায়নে গোয়াদার বন্দর নির্মাণের পর নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এই কৌশলগত মেগা প্রকল্পে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর অংশগ্রহণ বাদ দিয়ে অনেক সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হয়। ২০০৬ সালে বুগতি উপজাতির প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা আকবর বুগতির মৃত্যু পরিস্থিতিকে উল্লেখযোগ্য মোড় দেয়। তিনি বালুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, গভর্নর এবং রাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাজনৈতিক মতবিরোধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তার মৃত্যু ঘটেছিল। ফলে নিম্নস্তরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন দ্রুত দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী এবং অবকাঠামোর উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে হামলা পূর্ণাঙ্গ গেরিলা যুদ্ধে পরিণত হয়। রাষ্ট্র ও সামরিক স্থাপনাগুলোতে হত্যা ও বোমা হামলা চালানো হয়।
২০২২ সালের মধ্যে হামলা তীব্র করে বিএলএ এবং বালুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের (বিএলএফ) মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুুতে পরিণত হয় প্রধানত পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রেঞ্জার্স এবং ফ্রন্টিয়ার কোর। এই গোষ্ঠীগুলো প্রধানত মাররি এবং বুগতি উপজাতিগুলো পরিচালিত এবং দীর্ঘদিনের অভিযোগ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আফগানিস্তানে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে কাজ করে।
বিশেষজ্ঞরা বিএলএর ক্রমবর্ধমান পরিশীলিত কৌশলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তান থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রবাহে সম্পর্কিত করেছেন। ইসলামাবাদ আফগানিস্তানের তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার এবং ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, তারাই বালুচিস্তানে সংঘাত উস্কে দিচ্ছে। পাকিস্তানের দুই প্রতিবেশীই জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গত এক বছরে বিদ্রোহী হামলা প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়ে যাওয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দেয়ায় বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, পাকিস্তান এতে গভীর নিরাপত্তা সংকটের মুখোমুখি। বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সরকারের ব্যর্থতা এবং নির্বাচনী রাজনীতির প্রতি হতাশা বেড়ে যাওয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন বেড়েছে। অর্থনৈতিক সংকট এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধমীয় চরমপন্থি, এই দুই ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যে পাকিস্তানের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
বালুচিস্তানে চলমান বিদ্রোহ জটিল আন্তঃসম্পর্কিত কারণে প্রভাবিত, যার মধ্যে সম্পদ শোষণও অন্তর্ভুক্ত। প্রদেশটিতে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুত থাকা সত্ত্বেও এটি ন্যূনতম রাজস্ব পায়, যা অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অনেক অভিযোগ ও প্রতিবেদনও রয়েছে। সেনাবাহিনীর কঠোর দমন-পীড়ন, আঞ্চলিক ক্ষোভকে প্রকট এবং সংস্কারবাদীদের উগ্রপন্থি গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করেছে। ফলে অঞ্চলটি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। এছাড়াও, আফগান যুদ্ধের প্রভাব, বিশেষত পশতুন শরণার্থী ও তালিবানপন্থিদের অনুপ্রবেশ, জনসংখ্যাগত উত্তেজনা ও নিরাপত্তা উদ্বেগকে বাড়িয়ে তুলেছে।
সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তুলেছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, যেখানে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে বালুচ বিদ্রোহীদের সমর্থনের অভিযোগ করেছে। পাকিস্তানের এই দাবি যা শুধু সংঘাতকে তীব্র করে না বরং ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককেও আরও জটিল করে তোলে। এই কারণগুলো অস্থিতিশীল পরিবেশও তৈরি করে, যা বালুচ বিদ্রোহকে আরো স্থায়ী করতে প্রণোদনা দিচ্ছে এবং স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং কৌশলগত অবস্থান থাকা সত্ত্বেও, এটি পাকিস্তানের সবচেয়ে অনুন্নত এবং অস্থিতিশীল অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে। অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হলো, ইসলামাবাদের বালুচিস্তানকে সম্পদ-সমৃদ্ধ প্রান্তিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা, যেখানে উন্নয়নের চেয়ে সম্পদ আহরণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সুই গ্যাস ফিল্ড, সাইনডাক এবং রেকো ডিক খনির মতো প্রকল্পগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য রাজস্ব তৈরি করে, তবে প্রদেশটি ন্যূনতম রিটার্ন পায়। প্রাদেশিক সংবিধানে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রদেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ দেয়ার বিধান থাকা সত্ত্বেও, সরকার বালুচিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, যা স্থানীয় অসন্তোষকে আরও প্রগাঢ় করছে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং জোরপূর্বক গুম হওয়ার অভিযোগে চিহ্নিত দশকগুলোর অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছে।
ফেডারেল স্বায়ত্তশাসনের ক্ষয়ক্ষতি বারবার সংবিধানিক নীতিমালা লঙ্ঘনে আরও তীব্র হয়েছে। বর্তমান বিদ্রোহটি শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররাফের ২০০২ সালের একতরফা গোয়াদার বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্তে, যা জাতীয় পরিষদ, সাধারণ স্বার্থ পরিষদ এবং বালুচিস্তান প্রাদেশিক সরকারসহ গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানিক কাঠামোকে উপেক্ষা করেছিল। বালুচ বিদ্রোহ দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে। সংঘাত বাড়লে পাকিস্তান ভেঙে যেতে পারে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ইরান-পাকিস্তান-ভারত (আইপিআই) গ্যাস পাইপলাইনের মতো অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়াও, এই সংঘাত ভারত-পাকিস্তান শান্তি প্রচেষ্টাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনের অভিযোগ করছে, যা প্রক্সি যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে।
বালুচিস্তান বিদ্রোহ সমাধানে বিদ্রোহী, বালুচ রাজনৈতিক দল, কর্মী, সেনাবাহিনী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা প্রয়োজন। যদিও এটি অপরিহার্য, তবুও এই ধরনের আলোচনা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের আত্মতুষ্টি এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতা বালুচিস্তানের সংকটকে আরও তীব্র করেছে। যদিও হামলার সংখ্যা কমেছে; কিন্তু আত্মঘাতী হামলা বাড়ায় মৃত্যু বেড়েছে, যা বিদ্রোহীরা প্রতিরোধের কার্যকর উপায় বলে মনে করে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে সেনাবাহিনী দমনমূলক কৌশল অব্যাহত রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই সমালোচকদের আটক, জোরপূর্বক গুম এবং সামরিক ক্যাম্পে বিচারবহির্ভূত হত্যা। ২০২১ সাল থেকে মৃত্যু ক্রমাগত বেড়ে ২০২৪ সালে ৩২২-এ পৌঁছেছে। অতীতের উদ্যোগগুলো, যেমন ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি কর্তৃক চালু আঘাজ-এ-হকুক সংস্কার প্যাকেজ, বেলুচ অভিযোগগুলোকে সমাধান করার জন্য সামরিকীকরণ হ্রাস এবং আরও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে। তবে পরবর্তী প্রচেষ্টাগুলো, যার মধ্যে ২০১৫ সালে বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ড. আব্দুল মালিক বেলুচের নেতৃত্বেও, ব্যর্থ হয়েছে মূলত সরকারের প্রতি বিদ্রোহীদের গভীর অবিশ্বাসের কারণে, যারা মনে করে সরকার তার নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম।
বালুচ বিদ্রোহ পাকিস্তানের জন্য বহুমুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যার কৌশলগত, আঞ্চলিক, নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ প্রভাব অত্যন্ত গভীর। কৌশলগতভাবে, এই সংঘাত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের (ইজও) কেন্দ্রবিন্দু চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর সাফল্যকে হুমকিতে ফেলেছে। আঞ্চলিকভাবে, এই বিদ্রোহ পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে, যেখানে সীমান্ত পেরিয়ে বিদ্রোহীদের সমর্থনের অভিযোগ অস্থিতিশীল এই অঞ্চলকে আরও অস্থির করে তুলছে। অভ্যন্তরীণভাবে, পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবর্তে সামরিক দমন-পীড়নের ওপর নির্ভরতা ক্ষোভকে আরও গভীর করেছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করেছে।
এই বিদ্রোহের মূল কারণগুলোর সমাধান, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংলাপ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন শুধু বালুচিস্তানকে স্থিতিশীল করতেই নয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতেও অপরিহার্য। অর্থপূর্ণ সংস্কার ছাড়া সহিংসতার এই চক্র অব্যাহত থাকবে, যার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া এবং এর বাইরেও সুদূরপ্রসারী পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
সাইমন মোহসিন: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে