সরকার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করতে কতটা সক্ষম
রাজধানী ঢাকা এমনিতেই যানজটের শহর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। রাজনৈতিক পালাবদলের পর এই যানজট এখন অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথ দখল করে বিক্ষোভ, মিছিল মানববন্ধন করেন। এতে করে যানজট আরও বেড়ে যায়। সর্বশেষ ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবরোধের কারণে রাজধানীর রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ মানুষ, স্কুলগামী শিক্ষার্থী, কর্মজীবী, রোগী- সবাই পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। তবে এ নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। গাবতলী, আগারগাঁও, মহাখালী, মালিবাগ, ডেমরাসহ পুরো রাজধানীই যানজটে স্থবির হয়ে পড়েছে। অথচ এই রোগের কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না।
বিগত সরকারের আমলে একবার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে শেষ পর্যন্ত সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিথিল ভূমিকার সুযোগে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট এবং সংখ্যা বেড়ে যায়। সড়কপথে নানা ধরের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে গত ১৯ নভেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ তিন দিনের মধ্যে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে নির্দেশনা দেন। প্যাডেলচালিত রিকশা সংগঠন ঢাকা মহানগর রিকশা মালিক ঐক্যজোটের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক রিট পিটিশনের পর হাইকোর্ট এই নির্দেশনা জারি করেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
এরপর থেকেই ঢাকা মহানগরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের ডাক দেয়। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান চালকদের সংগঠনের নেতাদের মতে, ঢাকা মহানগরে বর্তমানে প্রায় ৭-৮ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে। এই পরিবহন বন্ধ হলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এক ধাক্কায় বেকার হয়ে পড়বে। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে নীতিমালা চূড়ান্ত ও আধুনিকায়ন করে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের নিবন্ধন, চালকদের লাইসেন্স ও রুট পারমিট প্রদান, প্রতিটি সড়ক মহাসড়কে ইজিবাইক, রিকশাসহ স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য পৃথক সার্ভিস রোড নির্মাণের দাবি জানান তারা।
এ কথা ঠিক যে, ঢাকায় রিকশা বা ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করা একটি কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান; কিন্তু ঢাকার ট্রাফিক একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধানের জন্য বহুমুখী প্রচেষ্টা প্রয়োজন। রিকশা প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলে আসছে, তাই রাতারাতি তাদের দূর করার চেষ্টা করা একটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ। ব্যাটারিচালিত রিকশা উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করে, তাই এই যানবাহনগুলোকে আরও নিরাপদ করার জন্য মান উন্নীত করণ এবং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা যেতে পারে। আরও বিবেচনাপ্রসূত উদ্যোগ নিতে হবে যতক্ষণ না বাস্তব বিকল্প বের করা যায়।
বাংলাদেশের শ্রমিক শক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠনকারী রিকশাওয়ালারা ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করে অপরিসীম উপকার লাভ করে। পায়ে ঠেলা রিকশা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশায় স্থানান্তর তাদের জীবনকে রূপান্তরিত করেছে, শারীরিক কষ্ট কমিয়েছে এবং তাদের আয়ের সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। এ যানবাহনগুলো শুধু পরিবহনের একটি মাধ্যম নয়; তারা লাখ লাখ মানুষের জীবিকার অর্থ। এই পরিষেবাটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে এই ব্যক্তিদের এবং তাদের পরিবারের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি হবে। এর প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে অনুভূত হবে, কারণ অনেকে তাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য এই রিকশাগুলোতে নির্ভর করে। সরকারকে সবসময় রিকশা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের পর পর্যাপ্ত বিকল্প প্রদান করতে হবে।
তবে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর জন্য একটি নকশা নির্দিষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাড়াতে এর নকশার সংস্কার প্রয়োজন। নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সংশোধন করার পাশাপাশি চলাচলেও শৃঙ্খলা আনতে হবে। এসব অটোরিকশার মূল সমস্যা হলো এর গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এর গতির তুলনায় ব্রেকিং সিস্টেম কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব বাহন দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে উল্টে যায় অনেক সময়; বেশি গতির কারণে বাঁক নেওয়ার সময়ও উল্টে যেতে পারে। এ ছাড়া জরুরি মুহূর্তে ব্রেক কষে থামতে না পারার কারণে অন্য গাড়ি বা পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া এসব অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির জীবনকাল খুব বেশি নয়। এই ব্যাটারিগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া সেসব ব্যাটারি কীভাবে ধ্বংস করা হয়, কেউ জানি না। এসব ব্যাটারি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা এলাকার প্রধান যানবাহনে পরিণত হয়ে গেছে। এই পরিবর্তনকে অনেকে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন বলে মনে করেন। কারণ, রিকশাওয়ালাদের শারীরিক ধকল প্রশমিত করার এই বাহনগুলো একদিকে আধুনিকতার প্রতীক, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব।
অনেকে এগুলোকে যান্ত্রিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক আখ্যা দিলেও বড়সড় কোনো দুর্ঘটনা এর ফলে ওই সব এলাকায় বেড়ে যাওয়ার কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি অবহেলা করা যায় না, ব্যাটারিচালিত রিকশা হঠাৎ ব্রেক করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা খুব বেশি হলে রিকশা ব্যবহারকারীরাই ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহারে অনীহা দেখাতেন। তবে সাইকেল-রিকশার মতো এগুলোর চলাচলকেও মহাসড়কে বৈধতা দেয়া যাবে না বোধগম্য কারণে।
সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অবিলম্বে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচলকে গ্রামগঞ্জে, নগর-মহানগরের ছোটখাটো সড়কগুলোয় ‘আইনত বৈধতা’ প্রদান করা যায় কি না, সেটা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। জাতীয় মহাসড়কগুলোয়, মহানগরের প্রধান সড়কগুলোয় এবং অন্যান্য নগরীর প্রধান সড়কগুলোয় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হবে।
সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে উদাসীনতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই ।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে