Views Bangladesh Logo

প্রতিবাদের নামে লুটপাট

এই ধ্বংসযজ্ঞের মানসিকতা থেকে উত্তরণ কি সম্ভব?

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

ত ৭ এপ্রিল গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদ এবং ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি সংহতি জানাতে গিয়ে বাংলাদেশের কিছু মানুষ যে বর্বরোচিত হামলা করল বাটা-কেএফসির শোরুমগুলোতে তা খবুই ন্যক্কারজনক। দেশের ছয় জেলায় ইসরায়েলি পণ্য রাখা ও বিক্রি করায় অন্তত ১৬টি রেস্তোরাঁ ও শোরুমে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, কক্সবাজারে পাঁচটি, চট্টগ্রামে তিনটি, সিলেটে পাঁচটি, গাজীপুরে চারটি, কুমিল্লায় একটি এবং বগুড়ায় একটি প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। হামলা, চুরি ও ভাঙচুরের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরিকৃত একটি ছবি বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, কয়েকজন লোক জুতা চুরি করে পালাচ্ছে। ছবিটা যতবার চোখের সামনে পড়ে ততবারই লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। আমাদের জাতি বোধহয় এত বড় লজ্জায় আর কখনো পড়েনি।

ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান বলে যে বাটার দোকানে হামলা ও চুরি হলো সেই বাটা কোম্পানি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান নয়, এর জন্ম চেক প্রজাতন্ত্রে, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের সময়, ১৮৯৪ সালে। কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন (কেএফসি)-এর প্রতিষ্ঠা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের লুইসভিল শহরে, যার প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল স্যান্ডার্স একজন খ্রিষ্টান, পরবর্তীতে যারা কোম্পানিটি কিনে নেন তারাও খ্রিষ্টান। তারপরও প্রতিষ্ঠান দুটিতে হামলা করা হলো কোন যুক্তিতে? কিংবা হামলাকারীরা কি আদৌ কোনো যুক্তি খুঁজেছিল?

ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর ঘটনাটি এমন সময় ঘটল যখন বাংলাদেশে চার দিনব্যাপী ‘বিনিয়োগ সম্মেলন’ শুরু হয়েছে। গত সোমবার শুরু হওয়া এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৪০ দেশের বিনিয়োগকারীসহ ছয় শতাধিক প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। এসব দেখে তারা কী ভাববেন? বিনিয়োগ করবেন? এমনিতেই রাজনৈতিক কারণে, নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশে অনেকে বিনিয়োগ করতে ভয় পান। আর গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে যত সব কাণ্ডকারখানা ঘটছে, মব-জাস্টিস, উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর আবির্ভাব- সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ আবারও হয়তো প্রশ্নের সম্মুখীনই হবে।

অথচ এই আন্দোলন-প্রতিবাদ কত তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারত। গাজার গণহত্যা বন্ধে বিশ্বব্যাপী এই গণবিক্ষোভ জাগ্রত হয়েছে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৫০টি স্টেটে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে মরক্কোসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। আর কোথাও তো বাংলাদেশের মতো এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেনি। এখন প্রতিবাদের বিষয়টি আড়ালে পড়ে গিয়ে ওই জুতা চুরির ঘটনাটিই সামনে এগিয়ে আসছে। এক মণ দুধে যেমন এক ফোঁটা চোনা পড়লে পুরো দুধটাই নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি কতিপয় নির্বোধের কাণ্ডে আমাদের সমষ্টির সমস্ত শুভ প্রচেষ্টাই বারবার ব্যর্থ হয়ে যায়।

কিন্তু এই হামলাকারী কারা? এখন এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দুষছেন। কেউ বলছেন এরা উগ্র মৌলবাদীরা উন্মত্ত হয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে, কেউ বলছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা বর্তমান সরকারকে হেয় করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এই কাজ করেছে। এই পক্ষে-বিপক্ষে দোষারোপের সংস্কৃতি বাংলাদেশে বহু পুরনো। দুষ্কৃতিকারীরা যে পক্ষেরই হোক তারা বাংলাদেশের নাগরিক এ কথা তো সত্য এবং যে কোনোভাবেই অনুপ্রাণিত-প্ররোচিত হয়ে হোক তারা তো বাটার দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাটের একটি লজ্জাজনক কাজ করেছে। যেটা প্রমাণ করে এই হামলাকারীরা আসলে মতলববাজ। মব-জাস্টিসের নামে একদল মানুষ লুটপাট, চুরির সুযোগ নিচ্ছে, এটাই বাস্তবতা, এটাই সত্য। এর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

এই যে লুটপাটের সংস্কৃতি- এটা তো আমরা বহু বছর ধরেই দেখছি বড় বড় ব্যবসায়ীদের, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেও। এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? শুধুমাত্র কয়েকটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলেই কি জাতির আদর্শ-দর্শন-মূল্যবোধের উন্নতি হবে? না-কি আমাদের একটি জাতিগত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন প্রয়োজন? কারণ আমাদের মননে, মানসিকতায় যুক্তিবোধ প্রতিষ্ঠিত না হলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়- এটা কঠিন সত্য।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ