বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা কি দেখে যেতে পারব!
প্রশিক্ষণ শেষ। শুরু হলো যুদ্ধজীবন। শপথ গ্রহণের পরের দিনই আমাদের যাত্রা। কোনো অবসর বা বিশ্রামের সময় ছিল না। আমাদের বিদায়ের পর অন্য একটি দলের প্রশিক্ষণ শুরু হবে এখানে, এই ভারতের একটি প্রদেশ ‘মেঘালয়’ রাজ্যের তুরার পাহাড়ে। এই প্রশিক্ষণ চলমান প্রক্রিয়া। কিছু জানোয়ার রাজাকার বাদে সমস্ত বাঙালি আজ ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ এই অমর শপথ আমাদের মস্তকেও গেঁথে গেছে। হয় মরব না হয় মারব। তার জন্যই আমাদের এই শপথ। আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল আমার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রায় ৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা একসঙ্গে আমরা শপথ গ্রহণ করি। অনুষ্ঠানটি সুশৃংখল এবং জমকালো করতে দুদিন মহড়া করি আমরা। শপথের দিনে ভারতের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও মজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি ময়মনসিংহের তৎকালীন এম এন এ রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। তিনি উদ্দীপনামূলক বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে।
তারপর আমরা জাতীয় পতাকা এবং পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ স্পর্শ করে মাতৃভূমি স্বাধীন করার জন্য সম্মিলিতভাবে শপথবাক্য উচ্চারণ করি। সবশেষে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা। তার জন্য ছোটখাটো অডিশনের মাধ্যমে আগেই দশজনকে বাছাই করা হয়। সেই দশজনের একজন আমি। এ আমার পরম প্রাপ্তি। অনুষ্ঠান শেষে আমরা দশজন মার্কপাস্ট করে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। গোটা অনুষ্ঠানটি চলে নিয়ম মাফিক একের পর এক, অটো। শেষে জাতীয় সংগীত। জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় অন্তরা গাইতে গিয়ে অনুভব করলাম আবেগে আমার কণ্ঠ বুঁজে আসছে। কণ্ঠ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমি আড় চোখে অন্য বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদেরও আমারই অবস্থা। সবাই কাঁদছে আর গাইছে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।’
পরের দিন ট্রাকে অস্ত্র তোলা হলো। বিদায়ের পালা। বিদায়ের সময় আবেগের দরোজা খুলে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল। ওস্তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে ওস্তাদসহ সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। বিদায় সব সময় কষ্টের এবং বেদনার; কিন্তু ওস্তাদকে ছেড়ে আসতে আমাদের এতটা কষ্ট হবে আমরা ভাবিনি। ওস্তাদ বিদায়ের সময় কান্না গলায় বললেন, ‘আমি চাই তোমরা তোমাদের মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত করো। তোমাদের দেশের স্বাধীনতার পতাকা আকাশে উড়তে থাকুক। তোমরা বিজয়ী হলে মনে করব আমিও বিজয়ী হয়েছি।’ একটি ট্রাকে অস্ত্র গোলা-বারুদ তোলা হলো। বাকি কয়েকটি ট্রাকে আমরা উঠে পড়লাম। আমরা চলে যাওয়ার পর-পরই আরও একটি বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি করা হবে। প্রশিক্ষণের জায়গা খালি থাকবে না। একদল যাবে আবার আরেকদল আসবে। তুরা ক্যাম্প থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
বাংলাদেশের ময়মনসিং সীমান্তের দিকে আমাদের ট্রাক ছুটে চলছে। যাত্রার মুহূর্তে জয়বাংলা ধ্বনিতে আমরা গর্জে উঠলাম। জয়বাংলা আমাদের রণসংগীত। যুদ্ধের প্রেরণা। রক্তে উন্মাদনা বাড়ায়। মনকে চাঙ্গা করে। সাহস জোগায়। ট্রাকের ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি ভাব এসে পড়েছিল। তন্দ্রার মধ্যে হঠাৎ পাহাড়িয়া সেই দোকানি মেয়ে- চানরিয়ার মুখটি ভেসে উঠতে লাগলো। আসার আগে দেখা করা হলো না। আর কি কোনদিন দেখা হবে? যে জীবনে শুরু হলো আমাদের সে জীবন অনিশ্চিত। আপনজনদেরই দেখতে পাবো কিনা সন্দেহ। সেখানে চানরিয়া নামের পাহাড়ি মেয়েটির কথা ভাবার অবকাশ কোথায়। তারপরও মেয়েটির সারল্যভরা হাসিমাখা মুখখানি চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠতে লাগলো; কিন্তু কিছুই করার নেই। এক জীবনে চানরিয়ার গল্প এখানেই শেষ। অনিশ্চিত এক জীবনের যাত্রা শুরু হলো আমাদের।
দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ক্যাম্পটি মাইল দেড়েক ভারতের ভেতরে। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প আর পাকিস্তানিদের কামালপুর ঘাঁটি বলা যায় মুখোমুখি। মাঝে দূরত্ব ১০ মাইলের মতো। পাকিস্তানিরা ইচ্ছা করলে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে শেল নিক্ষেপ করতে পারে। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প তাদের শেলিং রেঞ্জের মধ্যে পড়ে। অনুরূপ ভাবে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে কামালপুর পাকিস্তানি ঘাঁটিতে শেল নিক্ষেপ সম্ভব। কিন্তু উভয় দেশ তারা নিজেরা নিজেরা সংযম রক্ষা করে চলেছে। যুদ্ধ তখন পাকিস্তানি আর বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পটি উঁচু পাহাড়ের ওপর। অনেক বড় ক্যাম্প। একপাশে পাকা রাস্তা। রাস্তায় চলাচল করা মানুষদের পাহাড়ের ওপর থেকে ছোট ছোট বীর বামনদের মতো দেখায়। বাকি তিনদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
বিশাল জায়গাজুড়ে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প। ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন ক্যাম্পটির একপাশে লম্বা টিনের ঘর। আরেক পাশে লম্বা করে তাবু টানানো। ভেতরেও অনেক তাঁবু। যার একটিতে থাকতেন সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের। ডিপুটি কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন আহমেদ। প্রায় ৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান এখানে। আমাদের সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের। যিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন। যুদ্ধের শেষের দিকে কামালপুর ফ্রন্টে শেলের আঘাতে তিনি একটি পা হারান। একটি টিনের ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। মেঝেতে টানা বিছানা করে শোয়ার ব্যবস্থা।
বিকেলে আকস্মিক আক্তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আক্তার ভাই আমার পাশের গ্রামের মানুষ। গ্রামের নাম কালিপুর। তিনি ইপিয়ারে চাকরি করতেন। আমার সিনিয়র ভাই। আমার দুলাভাই রফিকুল আলম সেও ইপিয়ারে চাকরি করেন। তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আক্তার ভাইয়ের সঙ্গে দুলাভাইয়ের দেখা হয়েছে। তিনিও এখানেই ছিলেন। কয়দিন আগে তাকে বদলি করে অন্য একটি ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। শুনে আমার ভীষণ আফসোস হতে লাগল। কয়েকদিন আগে এলে দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো।
আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখে আক্তার ভাই একই সঙ্গে আনন্দিত এবং বিস্মিত। তার বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লাগল। আমার মতো আরও হাজার হাজার কিশোর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘সাবধানে থাকবে যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধের নিয়ম মেনে চলবে। অতি উচ্ছ্বাসে কিছু করতে যাবে না।’ আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করলাম। আক্তার ভাই ক্যাম্পে ‘ওস্তাদ’ হিসেবে পরিচিত। শুধু তিনি একা নন, ইপিয়ার ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের যারা ছিলেন তাদের সবাইকে আমরা ওস্তাদ বলে সম্বোধন করতাম। ওপরের অফিসারকে বলতাম স্যার। এসব সশস্ত্র বাহিনীর নিয়মের মধ্যে পড়ে। বাহিনীর নিয়ম বড় কড়া। সামান্য হেরফের হলে তাৎক্ষণিক শাস্তি।
দ্বিতীয় দিন আমাদের যুদ্ধযাত্রা শুরু। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ। ভোর রাতে ডেকে তোলা হলো আমাদের। ডেকে তোলার ধরনটা অভিনব। বাবা-মা যেমন গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। এখানে সম্পূর্ণ বিপরীত। পেটে ঘুসি মেরে জাগানো হলো। বলা হলো, ফলোইন। ফলোইন মানে লাইনে দাঁড়াতে হবে। চোখ কচলিয়ে লাইনে এসে দাঁড়ালাম। সংখ্যায় আমরা ২৫-৩০ জন। বলা হলো, কামালপুর সেক্টরে অপারেশনে যেতে হবে। একজন লেফটেন্যান্ট আমাদের কমান্ডার হিসেবে থাকবেন। কামালপুর সেক্টরের নাম শুনে গলাবুক শুকিয়ে গেল। ভয়ংকর বিপজ্জনক সেক্টর। অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ওই ফ্রন্টে শহীদ হয়েছে। নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য পাকিস্তানি আর্মিরা ঘাঁটির চারপাশে প্রায় ৩/৪ মাইলের মতো চারপাশ গাছ গাছালি কেটে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে সাফসুতের করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। যাতে দূর থেকে শত্রুর আগমন তারা লক্ষ্য করতে পারে এবং সেই মতো শত্রুর ওপর আক্রমণ করতে পারে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাইনোকুলার দিয়ে সারাক্ষণ খেয়াল রাখে।
আমরা ভোর রাতে কামালপুর সেক্টরের দিকে রওনা হলাম। যাওয়ার আগে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। কামালপুর ফ্রন্ট থেকে ফিরে আসা অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। এ জন্য কামালপুর ফ্রন্টে যারা যুদ্ধে যায় তারা সবাই বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যায়। আমরাও বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যুদ্ধ যাত্রা করলাম। প্রথম যুদ্ধযাত্রা। অন্যরকম থ্রিল। অন্যরকম রোমাঞ্চ মনে। তবে যুদ্ধে আমরা যাচ্ছি সাহায্যকারী হিসেবে। আমাদের কমান্ডার এমএমজি [মিডিয়াম মেশিন গান] চালাবেন। আমরা থাকব জোগানদার হিসেবে। একটি এলএমজি এবং কয়েকটি এসএলআর থাকবে। সেগুলো প্রয়োজনে কাভার ফায়ার দেবে। যুদ্ধের মুল শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে এমএমজি [মানে মিডিয়াম মেশিন গান]। এত ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ আমাদের দেওয়া হয়নি। আমাদের ভারী অস্ত্রের মধ্যে এলএমজির [মানে-লাইট মেশিন গান] ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। এই ভারী অস্ত্র আমরা চোখেও দেখিনি। যেহেতু আমাদের গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে তাই ভারী অস্ত্র আমাদের কোন কাজে আসবে না ভেবে এমএমজির [মিডিয়াম মেশিন গান] ট্রেনিং দেওয়া হয়নি। সাধারণ কোন মুক্তিযোদ্ধাকেই এই ভারী অস্ত্রের ট্রেনিং দেওয়া হয়নি। এই অস্ত্র আর গুলি বহনের জন্য ৫/৬ জন সাহায্যকারি লাগে। বিরাট অস্ত্র। সঙ্গে কয়েকটি স্ট্যান্ড। বড় বড় গুলি। এক একটা গুলির বাক্স অনেক ভারী। অনেকগুলো গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে আমরা সূর্য ওঠার আগে কামালপুরের দিকে রওনা হলাম। আমার সঙ্গে আমার গ্রামের বন্ধু সরকার আলী আসগরও আছে। লুঙ্গি উল্টো করে বেঁধে নিয়ে শুরু হলো আমাদের প্রথম যুদ্ধযাত্রা।
ময়মনসিংহের কামালপুর পাকিস্তানিদের ঘাঁটির ৩-৪ মাইল আওতার মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি। সম্ভবত ওরা আমাদের দেখতে পায়নি। আমরা একটি বাঁধের আড়াল দিয়ে মাথা নিচু করে এগিয়েছি। লেফটেন্যান্ট স্যার উঁচু একটি বাঁধের আড়ালে এসে পজিশন নিলেন। বেশ খানিকটা সময় লাগল অস্ত্র সেট করতে। এমন ভারী অস্ত্র এই প্রথম আমরা দেখলাম। অস্ত্র সেটিং করে তিনি আমাদের মাটিতে শুয়ে এবং কান চেপে ধরার নির্দেশ দিলেন। আমরা তাই করলাম। তিনি বায়নোকুলার দিয়ে ভালো করে ওদের অবস্থান দেখে নিয়ে জয়বাংলা বলে ফায়ার শুরু করলেন। বাপরে বাপ সে কি শব্দ, কানের তালা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। একটানা গুলি চললো কিছুক্ষণ। তা প্রায় মিনিট দশেক। বিকট শব্দে গুলি বেরুচ্ছে আর গুলির খোসা ছিটকে পড়ছে আমাদের চারপাশে। বড় বড় গুলি। নয়টা গুলির পর দশ নম্বর গুলি থেকে আগুন ছিটকে বেরুচ্ছে।
লেফটেন্যান্ট হঠাৎ গুলি বন্ধ করে অস্ত্র খুলে ফেললেন। আমাদের নির্দেশ দিলেন, ‘দ্রুত পজিশন চেঞ্জ করতে, ছুটতে ছুটতে বললেন, ‘মুভ।’ বলেই তিনি এমএমজির মূল অংশটা নিয়ে সামনের দিকে ছুটলেন। আমরা এমএমজির বাড়তি অংশ এবং গোলা বারুদ নিয়ে তাকে ফলো করলাম। আমরা সেই স্থান ত্যাগ করা মাত্র সেখানে মুহুর্মুহু মর্টারের শেল এসে পড়তে লাগলো। আমরা আর খানিকক্ষণ সেখানে থাকলে আমরা শহীদী তালিকায় ঢুকে যেতাম। আমি ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বন্ধু আজগার উরু পানিতে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি পরছে। বিপদের সময় তার লুঙ্গি খুলে গেছে। কি ভয়ংকর কথা। যুদ্ধের ময়দানে লুঙ্গি খুলে যাওয়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মর্টারের শেল চু-চইু-শব্দে ছুটে আসছে আমরা যেখানে পজিশন নিয়েছিলাম, সেইদিকে। আমার মনে হলো একটি শেল আজগারের মাথা বরাবর এসে পড়বে। আমি চিৎকার করে আসগরকে সতর্ক করতেই আসগর একহাতে লুঙ্গি খুট ধরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। আজগার সরে যাওয়া মাত্র শেলটি আজগার যেখানে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির গিঁট দিচ্ছিল ঠিক সেখানেই একটি হিজল গাছের ওপর বিকট শব্দে আছড়ে পড়ল। মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল গাছটি। আজগার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, ‘দোস্ত, তোর জন্য আমি আজ নতুন জীবন পেলাম।’ এখনো সে এই কথা চেনা পরিচিতদের কাছে বলে, আমি নাকি ওর জীবন বাঁচিয়েছি।
আমরা আরও কিছুক্ষণ লুকিয়ে থেকে লেফটেন্যান্টের নির্দেশ মতো অস্ত্র গোলা বারুদ এগিয়ে দিলাম। তিনি অনেকক্ষণ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে বায়নোকুলার দিয়ে ওদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘এবার আমরা সুবিধেজনক অবস্থানে আছি। স্যার বায়নোকুলারটি আমার হাতে দিয়ে এমএমজি আবার সেট করতে লাগলেন। আমি বায়নোকুলার দিয়ে পাকিস্তানিদের অবস্থান দেখছিলাম। কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার চোখে পড়লো। দেখলাম পাকিস্তানি আর্মিরা টাওয়ারে দাঁড়িয়ে চারপাশ লক্ষ্য করছে। লেফটেন্যান্ট স্যার প্রস্তুত হয়ে লাইং পজিশন নেওয়া মাত্র আমরা আগের মতো মাটিতে শুয়ে কান চেপে ধরলাম। একটানা কয়েক মিনিট ফায়ার দিয়ে স্যার উচ্ছ্বাস কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘জয়বাংলা।’ আমাদের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘অপারেশন সাকসেসফুল।’ বলেই পজিশন চেঞ্জ করতে বললেন। উনি দ্রুত এমএমজির মূল অংশ খুলে আলাদা করে ফেললেন। আমরা এমএমজি ভাগ ভাগ করে নিয়ে স্থান ত্যাগ করার পর স্যার বললেন, ‘ওদের কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ারের মধ্যে একটি উড়িয়ে দিয়েছি।’ শুনে আমরাও জয়বাংলা বলে উচ্ছ্বাসে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। স্যার বললেন, ‘ওই ওয়াচ টাওয়ারে যে কয়জন পাকিস্তানি আর্মি ছিল তারা সবাই খতম হয়ে গেছে।’
প্রথম অপারেশনের সফলতায় আমরা দারুণ উচ্ছ্বসিত। ফেরার পথে বার বার জয়বাংলা ধ্বনিতে আমরা লাফিয়ে উঠছি। বৃষ্টির মতো মর্টারের শেল এসে পড়ছে। আমাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে আমরা তখন আকাশে উড়ছি। জয়বাংলা ধ্বনিতে বার বার উৎসবে মেতে উঠছি। প্রথম যুদ্ধের সাফল্যের পর যুদ্ধের ভয়টা কেটে যায়। তারপর একে একে হাতিবান্ধা, ছাগলাপাগলা, ভাটপিয়ারি হাইস্কুল, ছায়দাবাদসহ আরও কয়েকটি স্থানে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেই। এর মধ্যে হাতিবান্ধা যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানিদের কাছে পরাজিত হই। আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৪ ডিসেম্বর কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা দল মিলে আমরা যখন সিরাজগঞ্জ শহর ঘিরে ফেলি তার আগের রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ট্রেনে চেপে পালিয়ে ঈশ্বরদী চলে গেছে। আমাদের সংবাদদাতা যথার্থ তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা ভীষণ আফসোস করতে থাকি। অল্পের জন্য শক্রুরা আমাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। তারপর আমরা বিনা বাঁধায় জয়বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করি। হাজার হাজার মানুষ তারাও জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে আমাদের স্বাগত জানায়। জয়বাংলা ধ্বনিতে উল্লাসে ফেটে পড়ে। আমাদের বীরোচিত সম্মান দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। সেই স্মৃতির কথা কোনদিন ভোলা সম্ভব না, অনন্তকাল জীবন্ত হয়ে থাকবে হৃদয়ে।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসর্মপণ করার খবর পেয়ে আমরা গুলি ফুটিয়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে উঠি। সে উল্লাস সে উচ্ছ্বাসের বর্ণনা করা কঠিন। জীবনে এতো আনন্দ আর কখনো পাইনি। সারা দিন কেটেছে আনন্দ মিছিলে। শুধু মনে বাজছিল আমরা স্বাধীন জাতি। আজ থেকে আমরা স্বাধীন। সেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আমিও ক্ষুদ্র একজন সৈনিক। আমাদের সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। নানামুখী ষড়যন্ত্রে দিশেহারা বঙ্গবন্ধুর একের পর এক ভুল করতে থাকেন। রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা করাটা আমরা মেনে নিতে পারিনি। সেদিন ঢাকার রাস্তায় শহীদ পরিবারের সদস্যারা বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করলেন কিন্তু তিনি নিজে ক্ষমা পেলেন না। তাঁকে হত্যা করা হলো। শুধু তাই নয় তার বংশ নির্বংশ করা হলো।
দেশের চাকা ঘুরে গেল। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো ধীরে ধীরে মিয়িয়ে যেতে থাকলো। স্বাধীনতার মূল স্তম্ভের একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। সেটা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া দেওয়া হলো। নিষিদ্ধ ধর্মীয় রাজনীতি আবার সচল হলো। সবচেয়ে বড় তামাশা শুরু হলো আমাদের নিয়ে। হোসেন মো. এরশাদের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়। সেই শুরু। তারপর খালেদা জিয়ার আমলে আবার নতুন তালিকা হলো। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তৃতীয় তালিকা করেন। প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আবার তালিকা করেন। তাতেও সংখ্যা বিশাল দীর্ঘ হয়ে যায়। সর্বশেষ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তালিকা টেনে লম্বা করতে থাকেন। শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে আমি দীর্ঘ একটি লেখা লিখেছিলাম। কিন্তু আমাদের কথা কে শোনে? তারপর কত উত্থান-পতন দেখলাম।
বর্তমানে যিনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম সাহেব একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। ‘অপারেশন জ্যাকপটে’র ডেপুটি কমান্ডার। দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম যুদ্ধ হলো ‘অপারেশন জ্যাকপট’। বিশ্বের অনেক মিলিটারি একাডেমির সিলেবাসে ’অপারেশন জ্যাকপটে’র মতো দুঃসাহসিক যুদ্ধটি পাঠ্য। দেশের জন্য অবশ্যই এটা গৌরবের। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন সঠিক তালিকা আমাদের উপহার দেবেন। শুরুতে তার কথায় আমি আশাবাদি হয়েছিলাম। তিনি যে প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করছেন তাতে তিনি সফল হবেন বলে মনে হয় না। তার চেয়ে বড় কথা, যেখানে সরকার প্রধান রিসেট বাটন চেপে দিয়ে অতীত মুছে দিতে চাইছেন সেখানে ভালো কিছু আশা করা দুরাশারই নামান্তর।
ইসহাক খান: বীর মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও টিভি নাট্যকার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে