নারীর প্রতি সহিংসতা
দেশকে নিজের বলে নারীরা ভাবতে পারবে?
৪ মার্চ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়া নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেন যে, তিনি ক্রমাগত হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন। টানা এসব হুমকির কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কথাও জানান তিনি।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার মঙ্গলী বাগচীর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। স্থানীয় ফুটবল খেলোয়াড় তিনি। দেড় বছর আগে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছিল। ‘এত বড় মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে কেন খেলে’- এই বলে বিদ্রুপ করা হয়েছিল। মারধরে আহত হয়েছিল আরও তিন কিশোরী খেলোয়াড়। এ নিয়ে স্থানীয় তিনজনের বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলছে। তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, সেই মঙ্গলী এখন আবার নতুন করে চাপের মধ্যে। নারী ফুটবলের বিরুদ্ধে একটি চক্র নতুন করে সক্রিয় হওয়ায় আতঙ্কে মেস ছেড়ে তিনি বাসায় চলে গেছেন।
গত ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে টিনের বেড়া ভাঙচুরের পর নারীদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচটি বাতিল করা হয়। পরে ৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলা প্রশাসন ঢাকা থেকে নারী দল এনে ওই মাঠে হাজারও দর্শকের উপস্থিতিতে খেলার আয়োজন করে। ৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় জয়পুরহাট নারী দল ও রাজশাহী নারী দলের খেলা বাতিল হয় বিক্ষোভের হুমকির মুখে।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ের একটি ছবি সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়েছে। বোরকা আর টি-শার্ট-প্যান্ট পরা দুই নারী লাঠি হাতে পাশাপাশি দাঁড়ানো। আন্দোলনের সময়ে পোশাক নিয়ে প্রশ্ন না উঠলে এখন কেন তোলা হচ্ছে? কেন ‘ওড়না গায়ে থাকা না-থাকা নিয়ে’ একটি মেয়েকে হেনস্তার শিকার হতে হয়? কেন নিপীড়নকারীকে ‘বরণ’ করা হয় ফুলের মালা দিয়ে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও লালমাটিয়ায় হেনস্তার শিকার ভুক্তভোগী নারীদের সঙ্গে পরিচিতদের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তারা জানিয়েছেন, ওই মেয়েরা মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না। ওড়না নিয়ে ঘটনার ভুক্তভোগী মামলা করলেও তা এখন চালাতে চাইছেন না। আর ধূমপানকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে মারধরের ঘটনায় মামলা হয়নি।
৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ১ মার্চ লালমাটিয়ায় হেনস্তার শিকার ভুক্তভোগী নারীদের সঙ্গে পরিচিতদের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। ওই মেয়েরা জানিয়েছেন, তারা মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না। ওড়না নিয়ে ঘটনার ভুক্তভোগী মামলা করলেও তা এখন চালাতে চাইছেন না। আর ধূমপানকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে মারধরের ঘটনায় মামলা হয়নি। তবে অভিযুক্ত মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার পর যেভাবে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়েছে তার ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজে। ঘটনা শুধু এখানেই শেষ নয়, অভিযুক্ত অর্ণবের পক্ষে এবং ওই মেয়ের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী তৎপর হয়ে ওঠে। নারীরা বাসা থেকে বের হতে ভয় পাবে। রাস্তাঘাট, জনপরিসর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মাদ্রাসা, খেলার মাঠ, ঘরে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন, নিপীড়ন ও হেনস্তার ঘটনাগুলোই নারীর ভয় বাড়িয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. মাহমুদা মিতু এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘আমার ইনবক্সের গালি, থ্রেট আর মেসেজগুলো যদি দেখাতে পারতাম, তাহলে যে কোনো সুস্থ মানুষ পাগল হয়ে যেত। সেক্সুয়ালি পার্ভাট লোকের সংখ্যা মারাত্মক হারে বাড়ছে।’
২০২৪-এ এক সেমিনারে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের চিফ অব স্টাফ ফৌজিয়া আফরোজ বলেছিলেন, ‘দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এমনিতে কম। রক্ষণশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণ নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। এর ওপর অপতথ্য ছড়ালে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
ওই সেমিনারে তিনি দেখিয়েছিলেন, রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম বা নির্বাচনের সময় যারা ক্রমাগত অপতথ্যের শিকার হন ডিজিটাল মিডিয়ায় তার শীর্ষ ১০ জনই নারী। ট্রলিং, ডক্সিং, ডিপফেক ছবি ব্যবহার, অন্তরঙ্গ ছবির ব্যবহার, যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য ইত্যাদির মাধ্যমে এই নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়েছেন।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোই যথেষ্ট নয়- পরিবারের, সমাজের প্রতিটি পরিসরের মধ্যে বৈষম্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। শুধু নারীদের কাছেই প্রচার করলে চলবে না, পুরুষদেরও জানাতে হবে যে, রাজনীতিতে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার সংরক্ষণ কেবলমাত্র পুতুল খেলা নয়, উন্নয়নের স্বার্থে এই উপস্থিতি প্রয়োজন। আদর্শ সমাজে সংরক্ষণের প্রয়োজন হতো না, স্বাভাবিক নিয়মেই অর্ধেক জনপ্রতিনিধি নারী হতেন। পুরুষতন্ত্রের ইতিহাস সেই অবকাশ রাখেনি। প্রকৃত দায়িত্বের অধিকারী হলে নারীরা যে তাতে ব্যর্থ হন না, সেই দৃষ্টান্তগুলোও সমাজের সামনে হাজির করতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে নুসরাত জাহান, উমামা ফাতেমারা যেমন অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছেন, পরবর্তী সময় অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, সামিনা লুৎফা, সাংবাদিক দীপ্তি চৌধুরী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, এমনকি উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পর্যন্ত কেউই রেহাই পাননি। তার আগে থেকে গণজাগরণ মঞ্চের অগ্নিকন্যা লাকী আক্তার ক্রমাগত যেভাবে সহিংস ডিজিটাল ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছেন, সেই একইভাবে এই সময় অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন বা সোহানা সাবাকে ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হতে হলো। এখানে আক্রমণকারীরা ভিন্নমতাদর্শী হলেও নারীর চরিত্র হননের বেলায় সবাই এক।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পুরুষকে আক্রমণ করার সময়ও সংশ্লিষ্ট নারীদেরই টার্গেট করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমনটা আমরা আগে ঘটতে দেখেছি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ত্রী বা মেয়র আতিকুলের মেয়ের বেলায়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখন দেখি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মেয়ের ক্ষেত্রেও। তিনি মিডিয়াকে বলতে বাধ্য হয়েছেন, তার পরিবারকে এভাবে আক্রমণ করা হবে জানলে তিনি এই পদে আসতেন না।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের একটি ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকের মধ্যে বিশেষ করে টার্গেট হয়েছেন আদৃতা রায়, সেটা তার বাবা অঞ্জন রায়ের পরিচয়ের কারণেই। কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে হেয় করতে চাইলে, সেই পরিবারটির নারী সদস্যকে বেছে নেয়াটা সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ধারা কমবেশি আগের মতোই রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার সংখ্যা কম। তবে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা জনমনে গভীর দাগ কেটেছে। বিশেষ করে বাসে ডাকাতির সময় নারীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতরা ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭১টি। এর মধ্যে ৬ হাজার ৮৬৭টি মামলা হয়েছে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০২৩ সালে মামলা হয়েছিল ১৮ হাজার ৯৪১টি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০টি মামলা হয়েছে।
রাজনীতিতে, খেলার মাঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাদ্রাসা, রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামাজিক অ্যাকটিভিজমে বা সেলিব্রিটিনিয়ায় নারীকে দমন করার, পীড়ন করার, চুপ করিয়ে দেয়ার, পিছিয়ে দেয়ার যে মোক্ষম অস্ত্র বাংলাদেশের পুরুষরা, কখনো কখনো তাদের সহযোগী নারীরাও ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন ডিজিটাল দুনিয়ায়, এর শেষ কোথায়? এই ভয়ংকর সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার নারীরা কোথায়, কার কাছে বিচার চাইবেন, যেখানে কখনো কখনো রাষ্ট্র নিজেই এই ধরনের আচরণকে উৎসাহিত করে চলেছে? আদৌ কি আমাদের বিচার চাওয়ার কোনো জায়গা আছে এ দেশে? আছে কি নারীদের সুবিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ?
১০ বছর আগে মোল্লা ওমরের তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের কাবুলে পুরুষরা বোরকা পরে নারী অধিকারের পক্ষে মিছিল ও প্রতিবাদ করেছিল। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘রাস্তাঘাটে নারীর বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের সহিংসতা বন্ধ কর।’ সেই সময় সংবাদটি বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এখন সেই প্রতিবাদের অবস্থাও নেই! বাংলাদেশে ‘তৌহিদী জনতা’ নামধারীরা যেভাবে নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকার হরণ করছে, তাতে কি আফগান তরুণদের মতো বাংলাদেশেও এমন প্রতিবাদ করতে হবে?
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গণপদযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল, প্রতিবাদ-সমাবেশ অব্যাহত থাকার মধ্যেই নতুন নতুন ঘটনা ঘটে চলেছে। গণঅভ্যুত্থানের পরপরই আন্দোলনকারী নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে নিপীড়নমূলক অপপ্রচার থেকে শুরু করে জনপরিসরে নারী নিপীড়নের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা উন্নত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উদ্যোগ তো নেয়নি বরং তাদের এই নীরবতা ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের প্রতি নতজানু সমর্থনকে প্রকাশ করছে।
দেশে সরকার আছে সেটা প্রধান উপদেষ্টা কিছুদিন পর পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ না দিলে কিংবা ‘ডেভিল হান্ট অপারেশন’ জাতীয় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ঘোষণা না করলে কিংবা রাত তিনটায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলন না করলে বোঝা যায় না।
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেয়া হলেও সরকারি পর্যায় থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া নেই। বিশেষ করে লালমাটিয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মন্তব্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার, সরকারের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি, তারা (দুই তরুণী) নাকি সিগারেট খাচ্ছিল, কিছু লোক সেখান দিয়ে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। তারা (লোকেরা) বাধা দেয়ায় তাদের ওপর চা ছুড়ে মেরেছিল।’ তিনি বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। তাই সবাইকে অনুরোধ করব, কেউ যেন উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান না করে।’
দায়সারা এসব বক্তব্য না দিয়ে নারী নির্যাতনকারীদের কঠোরভাবে দমনে সরকারের দৃশ্যমান কিছু কাজ আশা করে জনগণ। তা না হলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মাগুরার যে শিশুটি সিএমএইচে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, তার পরিবারও এ দেশকে নিজের বলে ভাবতে পারবে না। যদি আমরা দায়িত্ব এড়িয়ে যাই, এ শিশুটি ও অনাগত শিশুদের কাছে অপরাধী হব। প্রশ্ন হলো, এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র প্রস্তুত কি?
সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানী আঙুল তুলে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘ওরা আসেনি’। আর সেই বলার ছবি তখনকার পত্রিকায় মস্ত সংবাদ হয়েছে। সরকারকে বলছি, অনুগ্রহ করে প্রকাশ্য হোন। রাত তিনটায় নয়। দিনের আলোয়।
লেখক: কলাম লেখক ও সংগঠক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে