অযত্ন-অবহেলায় তারা কেউ সুস্থ হন না
কেউ জন্ম থেকে, কেউবা মানসিক আঘাত পেয়ে হারিয়ে ফেলেছেন স্বাভাবিক জীবন। হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগে গেলেই দেখা মেলে তাদের। সুস্থ করার আশায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও স্বজনদের ফিরতে হয় হতাশ হয়ে। অধিকাংশ সময়ই অসুস্থ রোগী নিয়েই বাড়ি ফেরেন তারা।
রোগীর স্বজনরা বলছেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও বছরের পর বছর ধরে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করেই যাচ্ছেন মানসিক রোগীরা। অনেকে সুস্থ হলেও তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। পরবর্তীতে ফের আগের মতোই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন চিকিৎসা নেয়া রোগীরা।
মনোরোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে দরকার উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, একপর্যায়ে গিয়ে স্বজনরা আশা ছেড়ে দেন। ধীরে ধীরে পরিবার ও সমাজ তাদের নিয়ে ভাবাটা বন্ধ করে দেয়। ফলে অযত্ন-অবহেলায় তারা আর সুস্থ হতে পারেন না।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার বাসিন্দা ৭৫ বছরের আমজাদ হোসেন। কিশোর বয়স থেকেই মানসিক রোগী তিনি। চার যুগেরও বেশি সময় আগে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নেয়ার বছর দুয়েক পর আবারও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে তার চিকিৎসা করা হয়। তবে ফলাফল একই, পরবর্তীতে ফের হারান মানসিক ভারসাম্য।
তার স্ত্রী জমেলা বেগম জানান, অনেকবার আমজাদের চিকিৎসা করানো হয়েছে। সুস্থ হওয়ার এক থেকে দুই বছরের মধ্যে আবারও অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন আমজাদ। এবার আমজাদের চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ তার কাছে নেই। স্বজনদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে সম্প্রতি চিকিৎসা করানো শুরু করলেও আশার আলো দেখছেন না তিনি।
বছর সাতেক আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন মোস্তফা (৪০)। মাসখানেক ধরে অনেক বেশি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন তিনি।
মোস্তফা বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেড়েরবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম মতিউর রহমান।
মতিউর বলেন, কোনোভাবেই ছেলেকে সুস্থ করা যাচ্ছে না। কিছুদিন ভালো থাকে, পরে আবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। চিকিৎসার জন্য বগুড়া শহরের বেসরকারি একটি ক্লিনিকে তাকে ভর্তি করানো হয়েছে। দেখা যাক এবার কি ফলাফল আসে।
গত ৫ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল চত্বরে নাজমুস সাকিব নামে একজন তার ছেলে সুজাউলকে (২৭) খুঁজছিলেন। দীর্ঘ সময় পর দেখা পান ছেলের।
হাসপাতালের দ্বিতীয় গেট সংলগ্ন মনোরোগ বিভাগ। সেই গেট দিয়ে বাইরে বের হন সুজাউল। রাত ১০টার দিকে সেই গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে হাসপাতালে প্রবেশ করতে না পেরে বাইরেই হাঁটাহাঁটি করছিলেন তিনি। সুজাউল প্রায় ১৫ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রাতে বাড়ি ফিরতেন তিনি। কখনো লুঙ্গির ওপর প্যান্ট আবার কখনো প্যান্টের ওপর লুঙ্গি পরে থাকেন সুজাউল। অন্যান্য রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে অনেক সময় ভালোভাবে কথা বললেও অল্পতেই রেগে যান তিনি। অনেক চিকিৎসা করানোর পরও তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অবশেষে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন তিনি।
নাজমুস সাকিব জানান, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ছেলের চিকিৎসা করাচ্ছেন। তার ছেলে কোনোভাবেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন না। এর আগেও শজিমেক হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন ছেলেকে। সবশেষে সুজাউলের কোনো পরিবর্তন নেই।
মাসখানেক আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন কবির হোসেন (২৪)। বর্তমানে তিনি শজিমেক হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগে ভর্তি রয়েছেন। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বাসিন্দা তিনি।
কবিরের বাবা তাহেরুল ইসলাম জানান, ছেলেকে নিয়ে সপ্তাহ দুয়েক ধরে শজিমেক হাসপাতালে রয়েছেন তারা। হঠাৎ কেন তার ছেলে এমন হয়ে গেল তা কারও জানা নেই।
শজিমেক হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগে সরেজমিন দেখা গেছে, মানসিক রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্বজনরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘ বছরের অসুস্থ রোগীকে সপ্তাহ দুয়েক সময় দিতেই আশা হারিয়ে ফেলেন অধিকাংশ স্বজন। এ ধরনের রোগীকে সুস্থ করার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় ধরনের বাধা। কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে একপর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের অযত্ন-অবহেলার শিকার হন তিনি। তারা যেন এক পৃথিবীর মানুষ হওয়ার পরও আলাদা। তাদের চিৎকার-আর্তনাদ একপর্যায়ে স্বজনদের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জানতে চাইলে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবু সায়েন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, মানসিক রোগীর বিভিন্ন ধরন আছে। কারও সারাজীবন, কারও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চিকিৎসা নিতেই হবে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তা আর হয়ে ওঠে না। চিকিৎসা নেয়ার মাঝপথে অনেকে তা বন্ধ করে দেন। অনেকেই রোগীকে থেমে থেমে চিকিৎসা করান। এতে করে মানসিক রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠছেন না।
তিনি আরও বলেন, একবার কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে দেখা যায় যে, পরিবার বা সমাজ তাকেই দায়ী করে। ফলে এ ধরনের রোগীরা অবহেলার শিকার হন। অথচ তারা কিছুই জানেন না। তারা কেন অস্বাভাবিক আচরণ করেন- তা জানলে তো তারা সুস্থই হয়ে যেতেন। এ ধরনের রোগীদের সুস্থ করতে হলে সর্বপ্রথম পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে