অর্থনীতি
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কর ফাঁকি দেয়ার সব রাস্তা বন্ধ করতে হবে
দেশ ও অর্থনীতির এই পর্যায়ে এসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ‘পুশ ফ্যাক্টর’র প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। যে কোনো মূল্যেই হোক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত করার জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কর প্রদানের উপযোগী বিপুলসংখ্যক মানুষকে এখনো ট্যাক্স নেটওয়ার্কের আনা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সঠিক পরিমাণে কর ও শুল্কায়নযোগ্য যে সব খাত বাইরে আছে সেগুলোকে শুল্ক ও করের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই পরিশীলিত, সংস্কারকৃত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়ে একটা করদাতাবান্ধব ও স্বয়ংক্রিয় প্রণোদনামূলক পদ্ধতি গড়ে তোলা বা প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কর প্রদান করছেন না, তাদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি কর ফাঁকি দেয়ার সব রাস্তা বন্ধ করতে হবে। কর দান ও আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতাসহ স্পর্শকাতরতা রয়েছে, তা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ব্যাংক নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সরল উক্তি, জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু ব্যাংক বাঁচানো যাবে না। কেন বাঁচানো যাবে না? তার উত্তর হচ্ছে, কোনো কোনো ব্যাংক থেকে ঋণের ৮৭ শতাংশই নিয়ে গেছে একটি পরিবার, যা আর ফেরত আসবে না। এ ধরনের বক্তব্য নতুন নয়, তিনি গভর্নর হয়েই বলা শুরু করে দিলেন যে, কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। শুরু হলো অস্থিরতা, গ্রাহকদের আমানত তোলার হিড়িক। শাখা ব্যবস্থাপকরা ব্যাংক শাখার দরজা বন্ধ করে গ্রাহকদের চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন, যারা কোমল হৃদয়ের তারা কান্নাকাটি করে গ্রাহকদের শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। গভর্নর বললেন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে তিনি কোনো ব্যাংককে এক টাকাও দেবেন না। আমানতকারীরা আরও বেশি হতাশ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। পরে বাস্তবতা উপলব্ধি করে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে টাকা ঢালতে লাগলেন; কিন্তু কাজ হলো না। কারণ আতঙ্ক দূর করা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। কীভাবে ব্যাংক থেকে একটি পরিবার টাকা নিয়ে গেল, কারা সহযোগিতা করল- এসব কথা কেউ বলে না। এস আলম পরিবার ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গেলেও পিস্তল ধরে লুট তো করেনি, নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে। ঋণ প্রদানে অনিয়ম হলেও জামানত থাকার কথা; না থাকলে কেন নেই, অফসাইট-অনসাইট পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলা ছিল কি না- তা নিয়ে কারও মুখে কোনো কথা নেই।
অর্থবছরের দ্বিতীয় ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি হবে চ্যালেঞ্জিং
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৫ মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। এই সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্যের লক্ষণ দৃশ্যমান হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতির চেয়ে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বেশি সময় ব্যয় করছে। নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হওয়ার পথে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে প্রস্তাবিত মুদ্রানীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২২ তারিখ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই মুদ্রানীতি অনুমোদিত হবে এবং তারপর তা প্রকাশ করা হবে। এটি হবে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মুদ্রানীতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই প্রথম মুদ্রানীতি। নতুন গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগ অন্যতম। তবে এ দুটি উদ্যোগ আরও আগেই গ্রহণ করা উচিত ছিল। আগে যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন তিনি এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে অর্থনীতির গতিপথ মন্থর এবং উল্টোমুখী হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিকট অতীতে যতগুলো মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে তার কোনোটিই প্রস্তাবিত মুদ্রানীতির মতো এতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল না। যদিও বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সবসময়ই কঠিন একটি কাজ।
অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণ জাতির আর্থিক স্বাধীনতা বিপন্ন করে
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। সেই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মার্কিন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কেন হচ্ছে না, সে সম্পর্কে তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো মার্কিন অধ্যাপকের বক্তব্য শ্রবণ করছিলেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক তরুণ শিক্ষক দাঁড়িয়ে মার্কিন অর্থনীতিবিদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আমাদের অর্থনীতির ওপর নানাভাবে হস্তক্ষেপ করছেন বলেই আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন অর্জন করতে পারছি না। মার্কিন অর্থনীতিবিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তরুণ অধ্যাপকের উদ্দেশে বলেন, যে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ৮০ শতাংশ অর্থ আমরা জোগান দিই, সেই অর্থনীতি কি আপনাদের নাকি আমাদের? আপনার যদি নিজস্ব উৎস থেকে উন্নয়ন কাজের অর্থায়ন করতে পারতেন তাহলে আমাদের পরামর্শ দেবার কোনো প্রয়োজন হতো না। তার এই বক্তব্য শুনে বাংলাদেশি তরুণ অধ্যাপক আর কোনো কথা না বলে বসে পড়েন।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান ছিলেন আমার শিক্ষক ও গাইড
যে কোনো মৃত্যুই কষ্টদায়ক। আর তা যদি হয় অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো ব্যক্তির মৃত্যু, তাহলে তা সহ্য করা খুবই কঠিন। অধ্যাপক আনিসুর রহমান ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। তিনি অনেক দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় অধ্যাপক আনিসুর রহমানকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানেই তিনি গত ৫ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমান ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তার পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ঘোষণাপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। তার এই মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। মানুষমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে; কিন্তু অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো মানুষের মৃত্যুশোক মেনে নেয়া খুবই কঠিন।
জনগণের অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণের পথে সরকারের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানার জন্য যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিল, সে কমিটি ইতোমধ্যেই তাদের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে। বিভিন্ন সূত্রে শ্বেতপত্রের যেসব দুর্নীতি অনিয়মের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই আতঙ্কিত করবে। দেশের অর্থনীতির অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয়, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
কেমন ছিল ২০২৪, কেমন হবে ২০২৫ সাল
বর্ষ পরিক্রমায় আমরা একটি নতুন পঞ্জিকা বছরে পদার্পণ করেছি। ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেসব বছর সবচেয়ে ঘটনাবহুল তার মধ্যে যে কোনো বিবেচনায়ই ২০২৪ সাল অনন্য হয়ে থাকবে। জনমত উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রচেষ্টা যে দীর্ঘ মেয়াদে কখনোই সফল হয় না ২০২৪ সালের ঘটনাপ্রবাহ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। স্থানীয় ও বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর আনুকূল্যে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত যে সরকার পতনের আন্দোলনের আন্দোলনে পরিণত হবে, তা আগে থেকে কেউ বুঝতে পারেনি। সরকারও বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। তারা হয়তো ভেবেছিল আগের আন্দোলনগুলোর মতো ছাত্র আন্দোলনও তারা হয়তো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে পারবেন; কিন্তু সরকার বুঝতে ভুল করেছিল যে, আগের আন্দোলনগুলোর মতো এবারের ছাত্রদের সংগ্রাম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল দীর্ঘ দিনের পরিকল্পিত একটি আন্দোলন, যা দমন করার ক্ষমতা সরকারের ছিল না।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিসংখ্যান মোতাবেক, গত নভেম্বর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এটা গত চার মাসের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। শহর এবং গ্রাম সর্বত্রই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উপনীত হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনীতিতে মুদ্রার জোগান কমিয়ে এনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা; কিন্তু বাস্তবে কোনো ব্যবস্থাই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হচ্ছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়তই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ধাবমান রয়েছে।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের চেয়ে কিস্তি আদায় জোরদার করা জরুরি
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের চেয়ে কিস্তি আদায় জোরদার করা জরুরি
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ব্যাংক অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ব্যাংক অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না