জ্বালানি ও খনিজসম্পদ
বাংলাদেশ-আদানি টানাপড়েন থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেল
সম্প্রতি এক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে অস্বীকার করছে’ এরকম আমি কিছু শুনেছি কি না। প্রশ্ন শুনেই আমি বুঝে গেলাম, একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে তিনি আসলে কোন প্রশ্নের বিষয়টি জানাতে চাচ্ছেন। আমি উল্টা প্রশ্ন করে বসলাম, ‘আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই যে, মাত্র কয়েক বছর আগেই আমাদের বিদ্যুৎ ছিল না। কারণ, আমরা জ্বালানি এবং কয়লা আমদানির অর্থ দিতে পারিনি?
সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে
দেশে ২৬ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এর বাইরে সাধারণত ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট এবং রাতেরবেলা ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। অর্থাৎ সর্বোচ্চ উৎপাদনের দিন বিবেচনা করলেও প্রতিদিন বসে থাকছে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করেই বসে থাকছে। এখন প্রশ্ন উঠছে এত বিদ্যুৎকেন্দ্রর কি আসলেই খুব দরকার ছিল!
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় বাড়ছে
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে। গত পাঁচ বছরের বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক লাফে গত অর্থবছর বিদ্যুতের আমদানি ব্যয় প্রতি কিলোওয়াট/আওয়ার বা ইউনিটে বেড়েছে ২ টাকা ৬ পয়সা। কেন এই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেল, এমন প্রশ্নে আদানীর কয়লা বিদ্যুতের আমদানি শুরু হওয়াকেই দায়ী করছেন সবাই। ঝাড়খন্ডে আদানি গ্রুপের এই কেন্দ্রটি কেবলমাত্র বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। দেশে যেসব আমদানি করা কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, তার চেয়ে কেন্দ্রটির বিদ্যুতের দাম খানিকটা বেশি বলে সমালোচনা রয়েছে।
প্রতিবেশীর নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাংলাদেশ হাত বাড়াচ্ছে কেন?
বিশ্ববাজারে সোলার ফটোভল্টিক প্যানেলের দাম কমতে কমতে প্রতি ওয়াট ১১ সেন্টে নেমে এসেছে। ইনভার্টার এবং কেন্দ্র নির্মাণে আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করলে ওয়াটপ্রতি খরচ পড়ছে ১৪ সেন্ট। এর সঙ্গে জমি কেনা আর সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনো ব্যয় নেই। এ পরিস্থিতিতে দেশেই নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আশার আলো দেখাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ চেষ্টা করছে নেপাল, ভুটান এবং ভারত থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে দেশে আনতে; কিন্তু কেন? তাহলে বাংলাদেশ কি প্রতিবেশীদের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনার দিকে বেশি নজর দিচ্ছে! এমন প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তিতাসের হিসাবে এত গোঁজামিল কেন
তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি সিস্টেম লস ২৩ ভাগ থেকে ৮ ভাগে নামিয়ে এনেছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি ১৪ ভাগ সিস্টেম লস কমিয়েছে। অর্থাৎ ১৪ ভাগ গ্যাস সাশ্রয় হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দাখিল করা এক বিবরণীতে তিতাস দাবি করেছে তাদের সিস্টেম লস ২ থেকে ৫ ভাগ। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিতাস এই সিস্টেম লস পেল কোথায়? না কি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য তিতাস গোঁজামিলের হিসাব দাখিল করেছে।
লোডশেডিং বাড়লেই কেন মনে হয় ৮টায় দোকান বন্ধ করতে হবে!
চীনের জনসংখ্যা ১৪১ কোটি। এই দেশে প্রতিদিন সন্ধ্যার মধ্যে বিপণিবিতান অর্থাৎ দোকান-পাট বন্ধ করার নিয়ম মানতে হয়। এই নিয়ম মানা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। সন্ধ্যা মানে সন্ধ্যাই, সে ৫টা হোক কিংবা ৬টা। ইউরোপ এবং আমেরিকায় একই নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। সন্ধ্যা নামার পর আর কেউ কেনাকাটা করে না। দোকানপাট খোলা রাখা হয় না। অর্থাৎ শিল্পোন্নত কোনো দেশই সন্ধ্যার পর আর মার্কেট খুলে রাখে না। তাহলে আমরা কেন রাত ৮টায়ও দোকান বন্ধ করতে পারি না? রাত ৮টায় দোকান বন্ধ করতে গেলে সরকারকে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়! বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো অভিযান পরিচালনা করলে রাত ৮টায় দোকান বন্ধ হয়। অভিযান থেমে গেলে রাত ১০টার আগে কেউ দোকান বন্ধ করে না। অন্যদিকে সরকারও দোকান বন্ধের বিষয়ে কড়াকড়ি করে কেবল লোডশেডিং বাড়তে থাকলে।
এলএনজির স্পট মার্কেট ঝুঁকি কি থেকেই যাচ্ছে
দেশের প্রধান জ্বালানি গ্যাস। দেশীয় খনি থেকে উত্তোলনের পাশাপাশি এখন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হয়। গত চার বছর ধরে সরবরাহ করা গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ আসে এলএনজি থেকে। ক্রমান্বয়ে সরকার আমদানি গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে। বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানে তেল গ্যাস না পাওয়া গেলে আমদানির কোনো বিকল্পও নেই; কিন্তু আমদানির কোন উৎসটি নিরাপদ, সেটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ জরুরি। প্রশ্ন উঠেছে সেই জায়গাতে আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি!
এই ‘টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ নিয়ে আমরা কী করব!
দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশে সরকার ‘টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ (স্রেডা) গঠন করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ নিয়ে কাজ করছে। গত ১১ মার্চ সংস্থাটি একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে। সেই গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের জীবাশ্ম জ্বালানি এবং বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্পগুলো সৌরচালিত সেচ পাম্পে রূপান্তরের জন্য ৬৬ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। পরিকল্পনায় দেখানো হয়েছে ২০৩১ সালের মধ্যে ১৭ লাখ পাম্পকে সৌর বিদ্যুৎচালিত করার পরিকল্পনা করছে স্রেডা।
মূল্য বৃদ্ধি না করে জ্বালানির বিকল্প সমাধান খোঁজার সুযোগ ছিল
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে ধরনের সংকট এবং চাপের মধ্যে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না; কিন্তু ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে। আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে করোনার পর থেকেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর পর থেকে অন্য সবক্ষেত্রের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে এলেও স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়নি।
রমজানকে সামনে রেখেই কেন জ্বালানি এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি!
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রমজানের আগে পণ্যের দামে ছাড় দেয়। ঠিক এর উল্টো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় আমাদের দেশে। এমন ঘটনা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের দামের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো একই ঘটনা ঘটবে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সেই মূল্যস্ফীতি আরও এক দফা উসকে দেবে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি বিভাগ বলছে মার্চের শুরু থেকেই বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক রমজানের আগেই এ ধরনের পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করতে হলো?